আমিনুল ইসলাম একজন সরকারি কর্মকর্তা। চাকরিজীবনের ১৪ বছর কেটে গেছে। অনেক দিন ধরেই বায়তুল্লাহ জিয়ারতের ইচ্ছা। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। এবছর স্ত্রীসহ হজে যাচ্ছেন তিনি। যাওয়ার আগে অফিসের শেষ কর্মদিবসে উপস্থিত অনেকের সঙ্গেই কুশল বিনিময় করেন। সহকর্মীদের সঙ্গে বিদায় বেলায় কোলাকুলির সময় বলছিলেন- 'ভাই! হজে যাচ্ছি, দোয়া করবেন। আল্লাহর রহমতে সুস্থভাবে যেন হজের সব কাজ সম্পাদন করতে পারি।’ উপস্থিত পরিচিতরাও এসময় হজযাত্রীর কাছে দোয়া চান।
এভাবেই হজে যাওয়ার আগে পরিবার, স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন বায়তুল্লাহর যাত্রীরা। বিদায়ের পরিবেশ হয়ে উঠছে আবেগঘন। গত কয়েক দিনে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ভবন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পরিকল্পনা কমিশনে এ ধরনের একাধিক দৃশ্য চোখে পড়েছে। কেউ হজের জন্য সহকর্মীদের কাছে দোয়া চাচ্ছেন, আবার সহকর্মীরাও হজযাত্রীদের কাছে বিভিন্ন দোয়ার কথা বলছেন। ভালোবাসার কোলাকুলিতে চোখের পানি ফেলছেন।
বিজ্ঞাপন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা তার সহকর্মীদের কাছে বিদায় নেওয়ার সময় অনেকেই হু হু করে কেঁদে ফেলেন। এসময় আবেগে ভারী হয়ে উঠে সেখানকার পরিবেশ। এই অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান, শামসুর রহমান খান, আজিজুর রহমান, কবিরুন নাহার, নসিরুল মিল্লাত, আবু তাহের, রউসন আরা বেগম, সুফি মোহাম্মদ রাফিউজ্জামান, মোস্তফা আমরান হোসাইন, উম্মে হাবিবা, তৌফিক আরেফিন, জাহিদুল খান, আবুল মালেকসহ আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রণালয় থেকে হজের ছুটি নিয়েছেন। অনেকেই ইতোমধ্যেই সৌদি আরব অবস্থান করছেন, আবার অনেকেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে দেখা গেছে, পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবার হজে যাচ্ছেন। স্ত্রী-পুত্রসহ এবার হজে যাচ্ছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। টুরিস্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের অনেকেই হজে যাচ্ছেন এবার। ২২ জুন হাবিব স্যার হজে যাবেন, আমরাও যেতে চাই সামনে, সে আশায় আছি।
পুলিশ সুপার মাকসুদা খাতুন স্বামীসহ এবার হজে যাচ্ছেন। পুলিশ কর্মকর্তা মুনাদির ইসলাম চৌধুরী, এসএম রফিকুল ইসলাম, সিফাত ই রাব্বানিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও এবার হজ যাচ্ছেন। হজে যাওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, আল্লাহর রহমতে ভালোভাবে হজ করতে চাই। সুস্থভাবে যেন দেশে ফিরে কাজে যোগ দিতে পারি দোয়া করবেন। এসময় তিনি জানান, হজের সফরে তিনি দেশ ও জাতির জন্য দোয়া করবেন। দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করবেন।
বিজ্ঞাপন
মাকে নিয়ে হজে যাচ্ছেন মৎস্য কর্মকর্তা মুহম্মদ মিজানুর রহমান। স্ত্রীসহ হজে যাচ্ছেন মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল আলম। স্বামীসহ যাচ্ছেন মৎস্য কর্মকর্তা সাঈদা ইয়াছমীন। স্ত্রী-শাশুড়িসহ যাচ্ছেন মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওমর আলী। এছাড়া মৎস্য কর্মকর্তা শেখ ফারজানা ইসলাম, মোহা. রফিকুল আলম, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, আরাফাত উদ্দিন আহম্মেদ, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক, রেবা বেগম, আতিকুজ্জামান, মশিউর রহমানসহ আরও অনেকেই এবার হজে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই কেউ কেউ মক্কা-মদিনায় অবস্থান করছেন।
হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে মক্কায় অবস্থান করা মৎস্য বিভাগের এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যেহেতু হজে এসেছি তাই নাম-টাম দেবেন না প্লিজ। তবে আমি প্রথমেই আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করছি। জীবনে আর আসতে পারব কি না জানি না। আমার দেশের মানুষের জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজেই দোয়া করি মহান আল্লাহর দরবারে। লাখ লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই এসে পৌঁছেছে। অনেকেই প্রথমে মদিনায় যাচ্ছেন, আমিও মদিনা থেকে পরে এই মক্কায় এসেছি। বাংলাদেশসহ যারা বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছেন, সবার জন্য আপনারাও দোয়া করবেন।’
স্ত্রীকে নিয়ে হজে গেছেন ময়মনসিংহের আব্দুল্লাহ আলিম। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাদের বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে হজক্যাম্পে আসেন তার ছেলে-মেয়েরা। হজ ক্যাম্পে এই সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সন্তান তার মা বাবাকে ধরে অঝোরে কাঁদছেন। পাশে আরেক হজযাত্রী যেতে যেতে বলছেন- বাবারা! কেঁদো না, আমাদের জন্য দোয়া করিও। বাবা আলিম তার ছেলে আফজালকে বুকে নিয়ে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছেন। আর বলছেন- এখানে অপেক্ষা করো না তোমরা, চলে যাও, আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। পুত্রবধূ শাশুড়ির হাত ধরে বারবার বলছিলেন- মা আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমাদের কোনো ভুল থাকলে ক্ষমতা করে দেবেন। আল্লাহ আপনাদের ভালোভাবে দেশে ফিরিয়ে আনুক।
হজক্যাম্পের আশপাশে এই দৃশ্য এখন প্রতিনিয়ত। অনেকেই তার বাবা-মাকে হজে যেতে এগিয়ে দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ এসেছেন কোনো স্বজনকে এগিয়ে দিতে। বিদায় বেলায় সবার চোখে-মুখে আবেগের অশ্রু। সবাই সবার কাছে দোয়া চাচ্ছেন। যারা যেতে পারেননি তাদের আকুতি একবার হলেও যেন পবিত্রভূমিতে যাওয়ার সুযোগ পান। আর যারা গেছেন তাদের প্রত্যাশা বারবার যেন যাওয়ার সুযোগ হয়।
বেসরকারি চাকরিজীবী মক্কায় অবস্থান করা আমিনুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, স্ত্রীসহ আসতে আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এখানে কোরবানির জন্য আলাদা টাকা দিতে হবে, তাই আমার ১৫ লাখের মতো লেগে যাবে। তবে এখন পর্যন্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভালোই আছে। আমার পরিচিত মানুষ অনেকেই এসে পৌঁছায়নি। আমাদের দলটি আগে এসেছে। আমার এলাকার আরও অনেকেই আসবে, তাদের ফ্লাইট ১৮ তারিখ।
১৯ জুন হজে যাচ্ছেন ইব্রাহিম। স্ত্রী সন্তানসহ চারজন একসঙ্গে যাচ্ছেন। ইব্রাহিম বলেন, সারাটি জীবনই ব্যবসার পেছনে সময় দিলাম। আল্লাহর ঘরে যাচ্ছি, দোয়া করবেন যেন আল্লাহ আমাদের অতীতের ভুলগুলো ক্ষমা করেন। যদি আর দেখা না হয়, কথা না হয়, কোনো কষ্ট মনে রাখবেন না, ভাই হিসেবে ক্ষমা করে দেবেন।
হজের খরচ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে খরচ নিয়ে কিছু বলতে চাই না, আলহামদুলিল্লাহ। তবে গতবারের চেয়ে একটু বেশি সেটাতো ঠিক। চারজনের জন্য যে বাজেট করেছিলাম সেখানে হুট করে ছয় লাখ টাকা বেড়ে গেল। এটি যদিও আমি সামলাতে পেরেছি, অনেকের জন্য হয়ত কষ্টের হয়ে গেছে।
গত ২১ মে থেকে হজযাত্রা শুরু হয়েছে, সৌদি আরবে যাওয়ার শেষ ফ্লাইট আগামী ২২ জুন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৮৬ হাজার ১৯৯ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন। চাঁদ দেখাসাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন হজ অনুষ্ঠিত হবে। হজ শেষে দেশে ফেরার ফ্লাইট শুরু হবে আগামী ২ জুলাই। হজযাত্রীদের ফিরতি ফ্লাইট শেষ হবে ২ আগস্ট।
ডব্লিউএইচ/জেবি