পবিত্র হজের সফর একটি বিশুদ্ধ ঈমানি সফর। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের সফর। এই সফরে বিশেষ আমলের অপরিহার্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি বর্জনীয় বিষয়ও রয়েছে।
হজযাত্রীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো—বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা হজের আলোচনা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেন, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যারা এ মাসগুলোতে (ইহরাম বেঁধে) নিজেদের ওপর হজকে অবধারিত করে নেয় তাদের কর্তব্য হলো হজের সময় সব ধরনের অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। সব গুনাহ ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ থেকে মুক্ত থাকা। তোমরা যা কিছু সৎকর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)
বিজ্ঞাপন
উক্ত আয়াতে তিনটি পাপ সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। ১) হজের সফরে কোনো অশ্লীল কথা ও কাজে লিপ্ত হবে না। ২) কোনো গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হবে না। ৩) কারো সঙ্গে কোনো ঝগড়া-বিবাদ করবে না।
পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত গুনাহের ব্যাপারে সতর্ক করার কারণ হলো—আল্লাহ তাআলা জানেন যে এসব গুনাহ মানুষ পবিত্র বায়তুল্লায় গিয়েও করতে পারে। ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও এ ধরনের পাপ সংঘটিত হত। অথচ পবিত্র জায়গায় যেকোনো নিষিদ্ধ বিষয়ের গুনাহ অনেক বেশি। তাছাড়া ইহরাম অবস্থায় যেকোনো ইচ্ছাকৃত গুনাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই বান্দাকে হারাম কাজ থেকে বাঁচাতে আল্লাহ তাআলা হজের বিধান অবতীর্ণকালে এসব পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন।
আরও পড়ুন: যে বিষয়গুলো না জানার কারণে মানুষ হজ আদায়ে গড়িমসি করে
আশ্চর্যজনকভাবে আল্লাহর এই নির্দেশের সঙ্গে হজযাত্রীদের গুনাহপ্রবণতার মিলও দেখা যায়। বহু লোকের সফর এবং বহু জায়গায় ভিড় হওয়ার কারণে মানুষ দ্রুত অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে এবং সফর-সঙ্গীদের সঙ্গে অনেকে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহার করে, বিভিন্ন স্থানে কর্মরত লোকদের গালাগাল, কথায় কথায় গিবত ও সমালোচনা অহরহ দেখা যায়। একে অপরকে কষ্ট দেওয়া, পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ, কটুবাক্য ব্যবহার, কারণে-অকারণে উত্তেজিত হওয়া, উত্তেজিত করা নিরেট ইবাদতের এই সফরে অধিকতর প্রকাশ পায়।
বিজ্ঞাপন
অথচ এগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ। ইসলামে হজের বিভিন্ন আমল পালন করতে গিয়ে একে অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। যেমন ভিড়ের কারণে অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করা সম্ভব না হলে দূর থেকে হাত তোলার নিয়ম আছে। অথচ এসব আদব শুধু হজের সফরে নয়, গোটা জীবনের বিধান।
ওলামায়ে কেরাম বলেন, সাধারণত যেকোনো নিষিদ্ধ কাজ করা পাপ। কিন্তু পবিত্র মাসে পবিত্র এলাকায় নিষিদ্ধ কাজ করার পাপ অত্যধিক। কারণ আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে মাসের সংখ্যা ১২টি, সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহের ব্যাপারে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ (সুরা তাওবা: ৩৬)
আরও পড়ুন: হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ
হজের পবিত্র দিনগুলোতে পবিত্র স্থানে, যেখানে শুধু আল্লাহর ইবাদতে আগমন করা হয়েছে সেখানে যেকোনো গুনাহের কাজ অত্যন্ত অন্যায়। যেখানে লাব্বাইকা লাব্বাইকা বলে তালবিয়া ধ্বনিত হচ্ছে, ইহরামের সাদা পোশাক সবসময় এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে তোমরা এখন ইবাদতে ব্যস্ত, সেখানে গালমন্দ করা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া, গিবত করা চরম নাফরমানির কাজ। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁরই নির্দেশগুলো মেনে চলা জরুরি। এক্ষেত্রে বড় জমায়েতগুলোতে কষ্ট সহিষ্ণু হওয়া ও পূর্ণ সংযম অবলম্বন করার বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ইবাদত হজে গিয়েও সেলফির ব্যবহার করছেন অনেক হজযাত্রী। ইহরাম বাঁধার স্থান (মিকাত) থেকে শুরু করে বিমানে, ইহরামে, বায়তুল্লাহ তাওয়াফে, জমজমের পানি পানে, সাফা-মারওয়া সায়িতে, আরাফাতের ময়দানে, মিনার কঙ্কর নিক্ষেপে এমনকি মাথামুণ্ডনেও সেলফি তুলে তা ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের হিড়িক চলছে।
আরও পড়ুন: সেলফি প্রবণতা হজের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী
অথচ সেলফি তোলার মূল উদ্দেশ্যই হলো আত্মপ্রদর্শন। যাকে শরিয়তের ভাষায় ‘রিয়া’ বলা হয়। অর্থাৎ এটি ছোটখাট গুনাহ নয়। বরং সবচেয়ে বড় গুনাহের প্রকার। ভুলে গেলে চলবে না, ঈমানকে ধ্বংস করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এই সেলফি। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘সামান্যতম রিয়াও (লোক দেখানো আমল) শিরক।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৯৮৯)
তাই সেলফিপ্রবণতা যেন হজের মহান উদ্দেশ্যে প্রভাব না ফেলে সে বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা হজযাত্রীদের প্রত্যেককে সবরকম গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। মাকবুল হজ নসিব করুন। আমিন।