বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি: শক্তি-সাহসের শপথ

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:১০ এএম

শেয়ার করুন:

রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি: শক্তি-সাহসের শপথ

বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শত বছরের গ্লানি মুছে লাভ করেছিল নবজন্ম—একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল তার আত্মপরিচয়। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন প্রধানত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও পরিণতিতে তা জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনাউৎস হিসেবে পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালির ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশের ইতিহাসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থই একটি মহত্তম দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মজাগরণের দিন, স্বাধিকারের স্বপ্ন বপনের দিন, আপন সত্তাকে বিপুল মহিমায় ঘোষণা করার দিন, সংঘশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণের দিন।

দুই।


বিজ্ঞাপন


আবার এসে গেল একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে বিশ্বব্যাপি স্বীকৃতিতে এখন এই দিনের অনুষ্ঠানের চাকচিক্য বেড়েছে। মুশকিল হলো, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ‘উৎসবীকরণ’ কতটা বাড়াতে পারে, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না। একবার পছন্দসই বিলিতি খাপে ভরে ফেলার পর, করুক না যত খুশি ওরা একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের বাছা বাছা গান শিখুক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা পড়ুক—তাতে সংস্কৃতিপ্রেমী আমরা গর্বিতই থাকি। লালপাড় সাদা শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা ইত্যাদি পোশাকে দিনটাকে বেশ উৎসব আমেজ দিলেই বা মন্দ কী! আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বরে হয়তো চোখে পড়ছে না যে শিকড়ের গোড়ায় কি টান পড়ছে।

সব অর্জনের বা গৌরবে এরকম দীর্ঘস্থায়িত্ব থাকে না সবসময়। হয় সে অস্পষ্ট—নয়তো ভঙ্গুর হয়ে যায়। অথবা প্রাসঙ্গিকতা তাকে ছেড়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস কিন্তু থেকে গিয়েছে, এত বছর পরেও একই রকম প্রাসঙ্গিক। কেবল একটি ভাষার জন্য। তার সম্মানের জন্য জীবন দেওয়ার কথা ভোলেননি কেউ, ইতিহাসেও তা একক। তবে বাংলা ভাষার অস্তিত্বযুদ্ধের পরিবর্তন হয়েছে, এ কথাও অনস্বীকার্য। এ যুদ্ধের একটি পরত নিশ্চয়ই বহুমাত্রিক, বহু ভাষাভাষী-পরাক্রম। দুই বাংলা ও দেশের বাইরে বসবাসকারী মানুষ মিলিয়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৩০ কোটি।

অবাক করার মতো একটি তথ্য—পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষা পঞ্চম। এই গৌরবের ভাষায় আত্মমর্যাদায় বাংলাদেশ তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সসম্মানে। কিন্তু আমরা সত্যি তার সম্মান রাখতে পেরেছি? বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা আমাদের কতটুকু? বহুলাংশে মাতৃভাষায় শিক্ষানীতির প্রচলনের উদোগ আজও সফল হয়নি। মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে নোম চমস্কির মত সুবিদিত। ভাষার মাধ্যমে বিষয়কে চেনা নয়—একই সঙ্গে ভাষা ও ইতিহাসের সাংস্কৃতিক পরম্পরা এক এবং অভিন্ন। প্রায়শ আমরা সেটি ভুলে যাচ্ছি।

তিন।


বিজ্ঞাপন


অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল ‘উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা’। আর সেই ঘোষণায় রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। মাতৃভাষার জন্য রুখে দাঁড়ানোর সেই দিনটি ছিল ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি। দিনটি আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ভাষার লড়াইটা হয়েছিল ঢাকাতে—কিন্তু সেই লড়াইয়ের বিস্তৃতি আজ গোটা বিশ্বে। মাতৃভাষা উচ্চারণ করতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের নিরন্তর যে লড়াই—তাতে সে দিন পাকিস্তানিদের বুলেটে হত রফিক, সালাম, শফিউর, জব্বার, বরকতেরা। আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁদের ভাষার জন্য লড়াইয়ের অনুকরণীয় শহিদ। সেই শহিদেরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার অতন্দ্র প্রহরী—বাংলাদেশ পেয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি। কাজেই ১৯৫২-র সেই জীবনদান বৃথা যায়নি। আর সে কারণে আফ্রিকার সিয়েরালিয়েনের শিশুরাও আজকের দিনে গেয়ে ওঠে—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ ভাষা শহীদদের স্মরণে এই গানটি লিখেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। সুর দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদ আলতাফ মাহমুদ।

চার।

১৯৫২ সালের ভাষার লড়াইটি বাঙালিকে চিনিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ধারালো রূপ। সে কারণেই ভাষার লড়াইয়ের পথ ধরেই এগিয়েছে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন। প্রতিটি পদক্ষেপেই রাজনীতির সঙ্গে প্রগাঢ়ভাবে মিশেছিল সংস্কৃতি। বাঙালির কাছে একুশে মানে নোয়ানো যায় না এমন মেরুদণ্ড ও সাহস। সেই সাহসে বাহান্নকে স্পর্শ করে রচিত হয় একাত্তর। সেই সাহসে পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেয় ৩০ লাখ বাঙালির রক্তের স্রোতে।

একুশ বাঙালিকে শিখিয়েছে যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াাই করতে। আমরা যখনই অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছি, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের সাহস। অবশ্য বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ অন্ধকার শক্তি হারিয়ে যায়নি। সে কারণেই মাতৃভাষার হাত ধরে থাকা মুক্তচিন্তা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপরে হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে। কারণ অপশক্তিরা ভালো করেই জানে—বাঙালির শিকড় তার ভাষার লড়াই, সেই লড়াইয়ের স্মৃতি থেকেই দৃঢ় হয়ে ওঠে এই বাঙালির সংস্কৃতির ঔদার্য। সে কারণেই আমরা দেখেছি, পাকিস্তানিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহিদ মিনার। তবে এই মিনার আমাদের কাছে ইট-সিমেন্টের একটি অবয়বই নয়, আমাদের হৃদয়ে স্থাপিত এক বাতিঘর। সেই কারণেই এই মিনার কখনো ভেঙে ফেলা সম্ভব না। এই চেতনার বিনাশ নেই—আছে বিকাশ।

পাঁচ।

মাতৃভাষার গৌরব উদযাপনে উৎসাহী হলেও আঞ্চলিক উচ্চারণের ক্ষেত্রে নাক ছিটকাতে অসুবিধা বোধ করি না আমরা। প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে অবজ্ঞা করে চলেছি। দিন দিন আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্রতা, গৌরবগুলো আমরা হারাতে বসেছি। এ ভাষাগুলোকে প্রকৃতভাবেই এখন লুপ্তপ্রায় বলা চলে।  পৃথিবীর কয়েকটি দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, সেইসব দেশে আমি দেখিনি, মাতৃভাষাকে ভাষা বাদ দিয়ে তারা অন্য কোনো ভাষায় চর্চা করতে। এমন দীনতা বা বিপন্নবোধ আমাদের দেশে ঘটছে।  

ঐতিহাসিক ভাষার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, বিভিন্নভাবে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার ভেতর প্রবেশ করে থাকে। আধিপত্য, বাণিজ্য, যাযাবরবৃত্তির কারণে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার শব্দে নিজের স্থান করে নেয়। এতে গ্রাসকারী ভাষাটি সমৃদ্ধ হয় সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষার ভেতর আরবি, উর্দু, ফারসি, ইংরেজি বহু ভাষার হানা আছে। বেশিরভাগ দস্যু যাযাবর লুটেরা বাংলায় সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টাকালে তাদের ধর্ম ও ভাষাকেও আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার বানিয়েছিল। পাকিস্তানিরা তাদের উর্দু ভাষাকে বাংলার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল; যা টেনে এনেছে একাত্তর।

তারা জানত না যে, পঞ্চাশ হাজার লোক নিয়মিত কথা বললে সে ভাষা বিলুপ্ত হয় না। তবে আমাদের ওপর সর্বশেষ যে দুটো আগ্রাসী ভাষা আগ্রাসন চালাচ্ছে তা হলো—ইংরেজি আর হিন্দি। এদের আক্রমণের উপায় ভিন্ন। এরা আমাদের কাছে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করতে আসে।

পুঁজিবাদ শুধু পণ্যনির্ভর নয়, ভাষানির্ভরও। বড় পুঁজির যারা কারবার করে, তাদের ভাষাও যে আধিপত্য বিস্তার করবে এটা পুঁজিবাদের ধর্ম। পণ্যায়ন মানুষকে নীতি, ভাষা ও সংস্কৃতিহীন করে তোলে। ক্রমশ ভোক্তাকে সাংস্কৃতিক শেকড়হীন করে তোলার ভেতর বাণিজ্য বিস্তারের রাজনীতি আছে। ‘বিশ্বায়ন’ এই ব্যবস্থার প্রকল্প। অন্যান্য ব্যবসার মতোই তারা ভাষা ও শিক্ষা ব্যবসায় নিয়েছে লাভজনক পরিকল্পনা।

ছয়।

সারা পৃথিবীতে ইংরেজি এক ভয়াবহ দানবে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্বায়নের যুগে মূল আধিপত্যই ভাষাভিত্তিক। একটা সময় ছিল লেখার সঙ্গে বা কথা বলার ফাঁকে একটু-আধটু ফরাসি বা হিস্পানি বলাটা আভিজাত্যের পর্যায়ে পড়ত। রাশিয়ার সাহিত্যিক তলস্তয় বা দস্তইয়েভস্কি বা অন্যান্য লেখকের লেখাতেও প্রচুর ফরাসি উদ্ধৃতি চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাপী সেই জায়গাটা শুধু ইংরেজি দখলই করেনি, পুরোপুরি ইংরেজিতে লিখতে পড়তে চিন্তা ও জীবনযাপন করতে প্রলুব্ধ করেছে, বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শিক্ষাকেও বাজারব্যবস্থার আওতায় আনার ফলে শিক্ষা এখন শিক্ষক-ছাত্রের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় বিনিয়োগের মাত্রা বাড়িয়েছে। বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থা এখন আন্তর্জাতিক করপোরেট বাণিজ্যের অন্যতম লাভজনক ব্যবসা।

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে, আর মনে করায়, শুধু সেই অমর শহিদদের জন্যই নয়, ইতিহাসের জন্যও নয়, ভবিষ্যতের জন্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলা ভাষার অক্ষর, কথন—এই ভাষ্য। ভাষার পাহারাদার হয়ে শুধু নয়, ভাষার লড়াইকে কেন্দ্রে ধারণ করেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে সব অন্ধকার, জিততে হবে সবগুলো লড়াইয়ে। আর সেই লড়াইয়ে একুশ আছে, থাকবে আমাদের শেকড় আর সাহস হয়েই। অতীত ইতিহাসের, ভবিষ্যতেরও এইটুকু দাবি তো মেটাতেই পারি আমরা সবাই মিলে, এই একুশে ফেব্রুয়ারিই শুরু হোক না সেই শপথ!

লেখক: সাংবাদিক

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর