স্বজন সান্নিধ্যে তিনি এখন আরও অনেক বেশি সুস্থ, আরও অনেক বেশি প্রফুল্ল। অথচ সাত মাস আগেও তিনি ছিলেন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মৃত্যুর হাতছোয়া দূরত্বে থাকলেও জীবনের প্রলোভনে তিনি সাড়া দেননি। হাসিনা তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে মুক্তির শর্ত হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু তিনি খালেদা। ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। হাসিনা, খালেদা জিয়াকে তার লেভেলে নামিয়ে আনতে হেন কোনো চেষ্টা নাই যা করেনি, কিন্তু পারেনি।
খালেদা জিয়ার বেসিক ইনস্টিংকটাই যে অন্য ধাতুতে গড়া। একজীবনে একজন মানুষের যা কিছু পাওয়ার থাকে, সব তিনি পেয়েছেন। গৃহবধূ থেকে দেশের সরকারপ্রধান। কী আর থাকে বাকি! নির্বাচন যদি একজন রাজনীতিকের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে থাকে, তবে নি:সন্ধেহে তিনি সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
বিজ্ঞাপন
কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। জনগণ তাকে সবসময় বসিয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে। জনগণকে কিছুমাত্র কমও দেননি তিনি। হেঁসেল থেকে রাজপথে তপ্তরোদকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ নয়বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পেয়েছেন,আপোষহীন রাজনীতিকের সুখ্যাতি। সরকার গঠন করে, নারী প্রগতির জন্য গ্রহণ করেছেন এক একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক, বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা সবই তার হাত ধরে সূচিত হয়েছে এই দেশে। রাষ্ট্রের যা কিছু ভালো, কল্যাণকর সবই তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই এসেছে।
জীবন সায়াহ্নে এসে, কথিত চোরের অপবাদ নিয়ে বন্দিজীবন কাটাতে হয় তাঁকে। উপযুক্ত চিকিৎসা সেবাও দেয়া হয়নি তাকে। যারা তার তিল পরিমাণ সমালোচনার যোগ্যতা রাখে না, তারাই এক সময় সকাল বিকাল তাঁকে মশকরা করছে। যারা লুটপাট করে, দেশকে ফতুর করে দিয়েছে, তারাই তাঁকে চোর বলতেও কসুর করেনি। এটা শুধু তাঁর ট্রাজেডি নয়,বাংলাদেশের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি কখনো, রিকনসিলিয়েশনের কথা বলতেন, অথচ তাকেই চরমপ্রতিহিংসার শিকার হতে হতে হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের দেশের ইতিহাসে তর্কিতভাবে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা তিনি। হাসিনা ভেবেছিল চোরের কথিত অপবাদে প্রহসনের বিচারে তাকে সাজা দিলে বুঝি তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে। জনগণ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু হাসিনা জনগণের মনের ভাষা পড়তে বড্ড ভুল করেছিল। মুক্ত খালেদা জিয়ার চেয়ে বন্দি খালেদা জিয়া জনগণের মাঝে আরও ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলেছিলেন।
হাসিনার সময়ে বিএনপির সমাবেশেগুলোতে মানুষের জনস্রোত তারই প্রমাণ। বেগম জিয়ার ওপর কী ধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করেছিল হাসিনার, সেটা ভাবলে থমকে যেতে হয়।
বিজ্ঞাপন
বছর দু-এক ধরে শাসক দল থেকে বলা হয়েছিল তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেই তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। হাসিনা সম্ভবত খালেদা জিয়াকে কখনোই চিনে উঠতে পারেনি। চিনবেই বা কি করে যার রন্ধ্রে বন্ধ্রে আপোসকামিতা। তিনি আপোষহীন নেতাকে চিনবেনা সেটাই স্বাভাবিক। খালেদা জিয়া অন্য ধাতুতে গড়া। ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। খালেদা জিয়ার জনগণের মাঝে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা জনপ্রিয়তা হাসিনাকে দিনকে দিন ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল আর তাই তিনি খালেদা জিয়ার রাজনীতিক মৃত্যু দিতে হেন উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
অথচ হাসিনা হয়তো জানত না, খালেদা জিয়ার মৃত্যু নেই, খালেদা জিয়ার ইতিহাসে অমরত্বের আসন আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর রাজনৈতিক মৃত্যু! অবৈধ সরকারের সাথে আপোষ করে সে মৃত্যু হাসিনার হয়েছে বহু আগে, ওয়ান ইলেভেনের সময়, যে সময় তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। আর গত পনের বছরে দেশে ফ্যাসিবদ কায়েম করে হাসিনা নিজেই নিজের কফিনে সে পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। কিন্তু বেগম জিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের যতসব অয়োজন দেখে দু:খের মধ্যেও কৌতুকবোধ করছিলাম।
একজন মানুষকে এত ভয়, এত পরোয়া হাসিনার! ভুলে যাই আমরা একটি প্রতিহিংসা হাজারটা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়.. এক মাঘে শীত যায় না.. তাই একজন খালেদা জিয়াকে মৃত্যু নিশ্চিত করে,রাজনীতির মাঠ নিষ্কন্টক করার স্বপ্ন, হয়তো হাসিনার দিবাস্বপ্নই থেকে গেছে...হাসিনার। খালেদা জিয়া এখন শুধু একজন মানুষের নাম নয়, অটোক্রেটিক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত সকল বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণাও বটে! আল্লাহ যাকে সম্মান দেন, কেউ সেটা ঠেকানো সাধ্যি কার!
হাসিনা আজ মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে প্রতিবেশী দেশে পলাতক দিন গুজরান করছেন। আর খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে বীরের বেশে আছেন। আজ রানীর মত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন।
দুই। খালেদা জিয়া ১৯৭১ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ। ২০১৮-তে কারাবন্দী খালেদা জিয়া। বাঙালি কমান্ডো মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম আসেন, সাথে সুন্দরী স্ত্রী খালেদা খানম পুতুল ও দুই শিশুসন্তান পাঁচ বছর বয়সী তারেক রহমান (জন্ম ২০ নভেম্বর ১৯৬৫) ও ৭ মাসের আরাফাত রহমান কোকো (জন্ম ১২ আগস্ট ১৯৭০)। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর তার আর কোয়ার্টারে ফেরা সম্ভব হয়নি, সাথের সেনানীদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিল।
অন্য বাঙালি সেনানীদের পরিবারের মতো ক্যান্টনমেন্টে রয়ে গেল মেজর জিয়ার পরিবার-পরিজনও। পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম দখল নিলে, বাঁচার তাগিদে দুই শিশুসন্তান নিয়ে প্রায় দেড় মাস চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করার পর অতর্কিতে একদিন কালো বোরকা পরে সপুত্র খালেদা খানম পুতুল মোটরলঞ্চে চট্টগ্রাম ছেড়ে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেন। সেখান থেকে বড়বোন খুরশীদ জাহান ও ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক একটি রেডক্রস চিহ্নিত জিপে করে তাদের ঢাকায় এনে ধানমন্ডিতে এক বন্ধুর বাড়িতে প্রায় দুই সপ্তাহ বসবাসের ব্যবস্থা করেন। একই সময়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, এ কে এম আহসান CSP-এর বাড়িতে অন্তরীণ ছিলেন। পরে খালেদা সপুত্র ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক কুমিল্লা একাডেমির মহাপরিচালক আখতার হামিদ খান ICS-এর যোগ্য সহকারী ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি তাহেরুন্নেছা আবদুল্লাহর স্বামী পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের পরিচালক ভূতত্ত্ববিদ এম আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে আত্মগোপনে থাকেন।
তাদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক চিরুনি অনুসন্ধান চালায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ ও ক্যাপ্টেন আরিফ এম আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২ জুলাই খালেদা জিয়া ও তার শিশুসন্তানদের গ্রেফতার করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ করে রাখে। ২১ আগস্ট মেজর জিয়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল জামসেদকে ‘বন্দী স্ত্রী খালেদা’ সাথে সম্ভ্রমের সাথে ব্যবহার করার জন্য একটি চিঠি পাঠান।
'Dear Gen. Jamshed, My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I will kill you someday, Zia' জিয়ার চিঠিটা মেজর শাফায়াত জামিল বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেওয়ানগঞ্জ থেকে পোস্ট করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর, সপুত্র খালেদা খানম পুতুলকে অন্তরীণমুক্ত করে ভারতীয় পূর্ব কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা প্লেনে সিলেটে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে মেজর খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ তাদের শমসেরনগরে মেজর জিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। কালের বিবর্তনে খালেদা খানম পুতুল পরিচিত হলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রধান খালেদা জিয়া রূপে এবং ১৯ মার্চ ১৯৯১ নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে খালেদা জিয়া আরো দু’বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সাময়িকী 'diem' (Forbes পরপর তিন বছর (২০০৪ থেকে ২০০৬) তাকে পৃথিবীর অন্যতম ‘প্রভাবশালী নারী’ চিহ্নিত করেছিলেন। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিনেট খালেদা জিয়াকে "Fighter for Democracy" সনদে সম্মানিত করেছিলেন।
খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, বাংলাদেশের এতিমদের সহায়তার জন্য কুয়েতের আমির ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার (৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা) প্রধানমন্ত্রীর ফান্ডে অনুদান পাঠান। ওই টাকা দিয়ে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট স্থাপন করা হয় এবং বগুড়া ও ঢাকায় দুটো জমি কেনা হয়। দুই ট্রাস্টের কোনোটির ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনো লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন না। ট্রাস্টের জমা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা বর্তমানে ৭ কোটি অতিক্রম করেছে। ৫ আগস্ট ২০০৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন ৫ (২) ও পেনাল কোডের ৪০৯/১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করে।
বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে ৫(২) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ২ কোটি ১০ লাখ অর্থদণ্ড করে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডস্থ পরিত্যক্ত শত একরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান।
২০১৯ সালে দণ্ড প্রদানকারী বিচারক আখতারুজ্জামান হাইকোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভাষ্যে বিএনপি নেত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কথিত ‘এতিমের টাকা চোর’। চোর অভিযোগ সম্পর্কে শেখ মুজিবুরের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘এগারো মাস মন্ত্রিত্ব করে ছিলাম। আমাকে চোর বলতে কারো বাধল না। আমি নাকি বলাকা সিনেমা হল করেছিলাম। আমাদের কিসমত যাদের জন্য রাজনীতি করি তাদের কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না, এই তো দুনিয়া। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে চোর বলেছে, হক সাহেবকে চোর বলেছে, নেতাজী সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা চোর বলেছে, দুঃখ করার কী আছে?’ খালেদা জিয়া আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? এই বাংলার মানুষ এখনো আপনাকে চায়, আপনাতেই ভরসা রাখেন। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না দিকে দিকে জাগরণের ধ্বনি।
তথ্যসূত্র : ৬. মাহফুজউল্লাহ, ‘Begum Khaleda Zia- Her life, Her History, দি ইউনিভারসাল একাডেমি, ঢাকা ২০১৮। ৭. মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ, বীর বিক্রম, ‘রক্তে ভেজা একাত্তর’ সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৩।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

