বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

সামাজিক মাধ্যমে থেমে নেই ভাষার বিকৃতি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সামাজিক মাধ্যমে থেমে নেই ভাষার বিকৃতি
ফাইল ছবি

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে। কিন্তু ভাষা নিয়ে মানুষের চিন্তার জগতে ঢুকে পড়েছে বিকৃতি। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে ভাষাকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে এই বিকৃতি চরম আকার ধারণ করেছে। কোনোভাবেই এটিকে রোধ করা যাচ্ছে না। ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সটাগ্রাম ছাড়াও টিভি ও ইউটিউব চ্যানেলে এই বিকৃতি মোটাদামে এখন সবার চোখে পড়ছে। কিন্তু ভাষা নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই নীরব। দেশে তেমনভাবে ভাষার বিকৃতি রোধে আইনও হয়নি। তবে সামাজিক মাধ্যমের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার নামেই বাংলা ভাষাকে বেশি বিকৃতি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ বুঝে আবার কেউ না বুঝেই ভাষার শব্দের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন। যদিও বছর কয়েক আগে আদালত রেডিও এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলো থেকে ভাষার যে বিকৃতি হয় তা রোধে উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় গঠিত কমিটি নয় দফা সুপারিশও করেছিল। কিন্তু সেইসব সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেটাই প্রশ্ন।

বাংলা ভাষার অনেক শব্দ বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। সুন্দরকে বলা হচ্ছে সুন্দ্রী, সেরকমকে আবার সেরাম। শুধু তাই নয়, জটিল একটি নেতিবাচক শব্দ হলেও সেটিকে ইতিবাচকে আনা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে আমার ও তোমার লিখতে গিয়েও সংক্ষিপ্ত করে লেখা হচ্ছে।

এর কারণ হিসেবে দিনাজপুর সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম মনে করেন, নতুন প্রজন্ম ভাষার গভীরে প্রবেশ করছে না। নিজেদের যে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদা আছে সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার ফলে এটি হচ্ছে। ‌ নতুন এই প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে ভাষার যে বিকৃতি হচ্ছে সেটা তারা অনুধাবনই করতে পারছে না। বর্তমানে টিভি ও রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নাটকের সংলাপ থেকে পাওয়া শব্দগুলো নতুন প্রজন্ম অনুকরণ করছে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, শুধু ফেসবুক নয়, ইউটিউবে বিভিন্ন নাটক, শর্টফিল্ম ও কৌতুক কনটেন্টে ভাষার বিকৃতি চোখে পড়ে। বিষয়টি দেশের অনেকেই জানে, কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কোনো উদ্যোগ নেন না। হরহামেশাই বন্ধুরা সামাজিক মাধ্যমে এক্সম বলছে, কোথাও যেতে মন চাইলে বলছে ট্যুর দিতে হবে। এছাড়াও ফিক্সড, এবনরমাল, হেচিং, ক্যাচাল, জাউগগা, চিল এসব শব্দ শুনতে হয়। যা দুঃখজনক। নাটকগুলোতেও যা শুনছি তা তো উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যাওয়ার অবস্থা।


বিজ্ঞাপন


টিভি ও ইউটিউবে প্রচারিত নাটকগুলোতে বেশি ভাষার বিকৃতি ঘটছে বলে মনে করেন রংপুরের নাট্যকর্মী ও সংগঠক ফরহাদুজ্জামান ফারুক। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আগে নাটকের সংলাপে সাধু ভাষার বেশি ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে বিকৃতিও ঘটছে। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকে সেই সব সংলাপ শুনে ভাবছে এটাই হয়ত বাংলা ভাষার শব্দ। কিন্তু আসলে তো তা নয়।

ভাষার বিকৃতি ঘটছে বেশির ভাগ উঠতি যুবক-যুবতীর মাধ্যমে। তারা কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো মনের বেখেয়ালেই নানা শব্দ যোগ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, একে অপরের সাথে চ্যাটিং করে মনের ভাব প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারী ভাষার সংক্ষিপ্ত ব্যবহার করতে গিয়ে তার বিকৃতি ঘটাচ্ছেন। বর্তমান প্রজন্ম যেভাবে বাংলাকে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে বিকৃতি ঘটাচ্ছে এবং তা উপস্থাপন করছে, বিষয়টি মোটেই ভালো নয়। এর পরিণতি খুব খারাপ ইঙ্গিত করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ভাষার ভুল প্রয়োগে নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে শিশুরা ভুল শিখবে। ভাষাকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করা হচ্ছে।

রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং লেখক ও ছড়াকার জাকির হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষা নিয়ে ইনস্টিটিউট বা বাংলা একাডেমি যাই বলি না কেন তারা কিন্তু ভাষা বিকৃতি হলেও তেমন কোনো শক্ত আইন প্রয়োগ করছে না। আর আইন থাকলে শক্ত প্রয়োগ দরকার। আইন না থাকলে আইন করতে হবে, যাতে উল্লেখ থাকবে -বাংলা ভাষার বিকৃতি কোনোভাবেই করা যাবে না।

তিনি মনে করেন, বাংলা একাডেমি বানান সংশোধনের নামে নানা সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু তারা বই বা সিনেমা বা নাটকের সংলাপে যে ভাষার বিকৃতি ঘটছে সে ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে পারছে না। বিষয়টি তাদের মনোযোগী হওয়া দরকার। এছাড়াও আঞ্চলিক ভাষার নামে বাংলা ভাষাকে চরমভাবে বিকৃত করা হচ্ছে। এ বিষয়টিও কঠোরভাবে নরজদারি করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

ভাষার বিকৃতি রোধে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষা দূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সেই লেখায় বলেছিলেন, ‘ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চর্চা আমাদের ভাবায়। শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলা ভাষা তার রূপ হারিয়ে কোনো শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে। অন্যদিকে শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে যারা রক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, তারা বলেন- এত ভাবাভাবির কী আছে, ভাষা চলবে ভাষার মতো। এর ব্যবহার-প্রয়োগে পরিবর্তন আসবে ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রকাশের প্রয়োজনেই। দুপক্ষের ভাবনাতেই সত্য আছে- বাংলা ভাষা যে সত্যি সত্যি একটি মিশ্র ভাষা হয়ে যাচ্ছে এবং এর নানা স্থানচ্যুতি ঘটছে।’

এই লেখার সূত্র ধরে পরে আদালত বেঞ্চ গঠন করে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। ভাষাদূষণ ও বিকৃতি রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি গঠন করে। পরে কমিটি নয় দফা সুপারিশ করলেও সেগুলোর অধিকাংশই আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

রেডি, টিভি ইউটিউবের কনটেন্টে ভাষা বিকৃতি

গত এক যুগে রেডি ও টিভির সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে এসব মিডিয়ার অনুষ্ঠানমালার বহরও। সেই সাথে একবিংশ শতাব্দীতে যুক্ত হয়েছে ইউটিউব। ইদানীং বিভিন্ন মিউজিক ও প্রডাকশন হাউজগুলো নিজেরাই ইউটিউবে চ্যানেল খুলে নাটক, কৌতুক ও গানের ভিডিও আপলোড করছে। এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগেই বেশি ইউটিউব খোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তৈরি করা কনটেন্টের ভেতরে ডায়ালগ, গানের ভাষা, নাটকের সংলাপের বেশির ভাগই তাদের মনগড়া শব্দ ও বাক্য। ফলে ভাষার বিকৃতিটাই এসব কনটেন্টের মাধ্যমেই বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন বেশির ভাগ মানুষ।

‌শুধু নাটক ও কৌতুকেই নয়, বিজ্ঞাপনেও ভাষার বিকৃতি ঘটছে অহরহ। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘আবার জিগায়’ ‘খাইলেই দিশ খোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’ ‘আব্বে মামু’ ‘লমু আর যামু’ এর মতো শব্দ।  আর নাটক-সিনেমায় ফার্স্ট ডেট, হাইজফুল, ছাইয়্যা ছাইয়্যা, লাভ ডট কম, মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে, ফাইস্যা গেছি মাইনকার চিপায়, ফিল্মি কথা বাদ দাও, এক্সটা খাতির নাই, ফিল্মি ডায়ালগ মারতাছ নামের শব্দও ব্যবহার করা হচ্ছে। ফেসবুকে দেখা যায়, কিছু শব্দকে সংক্ষিপ্ত করে কিছু শব্দকে বিকৃত করে ব্যবহার হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক মনে করেন, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও নিজস্বতা থাকার কারণে সামাজিক মাধ্যমে মানুষ যে যার মতো বাংলা ভাষাকে উপস্থাপন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার ও প্রক্রিয়া চালুর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল সেটির শুরু থেকেই ঘাটতি ছিল এবং সেই সিদ্ধান্তে যথেষ্ট ঘাটতি এখনো আছে। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পরেও দেশের সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়নি। সেই অবস্থাও তৈরি হয়নি। ফলে আজকে যে যেভাবে পারছে বাংলার সাথে ইংলিশ মিশেল করে বিকৃতির যে বাংলিশ টাইপের প্রবণতা বা একটা অবস্থা তৈরি করেছে। এভাবে ভাষার ব্যবহার করে কেউ যে শাস্তির আওতায় এসেছে সেটাও আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। এছাড়াও বইমেলায় প্রচুর বই পাওয়া যায় যেগুলোতে বইয়ের বানান ঠিক নেই।

তিনি মনে করেন, উত্তোরণের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে যারা অরুচিকর বা নোংরাভাবে বা সংস্কৃতি বহির্ভূতভাবে ব্যবহার করবে বিকৃতি ঘটাতে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অন্যদিকে উত্তরের জনপদ দিনাজপুর সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস সহকারী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম বলছেন, আজকের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভাষার প্রতি যে ভালোবাসা ও ভাষার যথাযথ প্রয়োগ কিংবা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।‌‌ পাশাপাশি ভাষার প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হলেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর