১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রিবেলা। তাজউদ্দীন আহমদ একটা কাগজে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে সেটা নিয়ে গেছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে। সঙ্গে আছে একটা টেপ রেকর্ডার। তার ইচ্ছা- শেখ মুজিবুর রহমান এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করবেন এবং তিনি সেটা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করবেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেলে তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবকে নিয়ে যাবেন পুরান ঢাকার একটা বাসায়। বাসা ঠিক করা আছে। সেই বাসায় আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। এটা অবশ্য শেখ মুজিবকে আগেই জানানো হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
শেখ মুজিব তখন সায়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু ২৫ তারিখের এই রাতের বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পরও শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ জিদ দেখানো শুরু করলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে আনা কাগজে তিনি সই করতে চান না। টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণাও রেকর্ড করতে চান না।
তাজউদ্দীন আহমদ পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। পৃথিবীর বহু দেশে এরকম উদাহরণ আছে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন। এখন এই পরিস্থিতির পরও স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়া মানে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা। কিন্তু শেখ মুজিব যেন সেই আত্মহত্যা করতেই বেশি ইচ্ছুক। কোনোভাবেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি নন।
পীড়াপীড়ির একপর্যায়ে তাজউদ্দীনকে বলেই ফেললেন, ‘বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও, যাও। পরশুদিন হরতাল ডেকেছি। এর আগে আর কিছু করার নেই।’
তাজউদ্দীন আহমদের পুরো অস্তিত্বজুড়ে যেন হতাশা ছেয়ে গেল। যে মানুষটার এই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্ত হওয়ার দরকার, যে মানুষটার এই মুহূর্তে হাল ধরার দরকার, তিনি দিব্যি আছেন নির্ভার আর চিন্তামুক্ত! শহরে গণহত্যা চলছে! পালিয়েও মানুষের জান রক্ষা হচ্ছে না। সেই মুহূর্তে একজন নেতা এভাবে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারেন? এও সম্ভব?
বিজ্ঞাপন
এটাও যে সম্ভব সেটা তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারলেন পাশের ঘরে বেগম মুজিবকে দেখে। বেগম মুজিব শেখ মুজিবের জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছেন। শেখ মুজিবের ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরছেন। দেশ উচ্ছন্নে যায় যাক! একটু পরে পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে নিতে আসবে। তাদের সাথে যেতে তো হবে!
ধানমন্ডি ৩২ থেকে চলে আসার আগে তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের কাছে আরেকবার অনুনয়বিনয় করলেন। শেখ মুজিব অনড়। স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘তোমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাব না।’
তাজউদ্দীন শুধু হতাশ গলায় বললেন, ‘আপনার অবর্তমানে কে নেতা হবে তাও তো কিছু বলেননি। এমন অবস্থায় দ্বিতীয় কেউ এসে নেতৃত্ব নেবে এটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কাল থেকে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে সেটা তো অনিশ্চিত আর জটিল হয়ে গেল।’
বোঝা গেল তাজউদ্দীনের কথা শেখ মুজিবের খুব একটা কানে গেল না। রাত নয়টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ বাসায় ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চিত্তে। বাসায় এসে স্ত্রীকে সব খুলে বললেন। রাগ আর অভিমান জড়ান কণ্ঠে বললেন, ‘মুজিব ভাই কিছুতেই তার বাসা থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবেন না। আমি আর কি করব? থাক, আমি আর কোথাও যাব না।’
ঢাকার খবর কিছুটা কানে আসতেই চট্টগ্রামের মানুষজন বুঝতে পেরেছে, দেশের অবস্থা খারাপ৷ তারা চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচল বন্ধ করার জন্য চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড দিয়েছে। এসব ব্যারিকেড সরানোর মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। পাঞ্জাবি মেজর কামাল আর বাঙালি মেজর আজিজ রাস্তার ওপরের ব্যারিকেডগুলো সরানোর কাজ শুরু করেছে।
ক্যাপ্টেন অলির কাছে খবর এসেছে ঢাকায় গণহত্যা চলছে। চট্টগ্রামের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। খবরটা খুব দ্রুত মেজর জিয়ার কাছে পৌঁছাতে হবে। খুব বেশি দূরে নয়, মেজর জিয়াউর রহমান তখন নিচতলাতেই বসে আছেন। ক্যাপ্টেন অলি যখন দোতলা থেকে নিচতলায় নামলেন দেখলেন, মেজর জিয়াউর রহমানের পাশে কর্নেল জানজুয়া আর মেজর শওকত। কর্নেল জানজুয়ার সামনে কোনোভাবে মেজর জিয়াকে এ খবর দেওয়া ঠিক হবে না। ক্যাপ্টেন অলি কী করবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না। হাতে খুব বেশি সময় নেই।
মেজর জিয়াকে যত দ্রুত সম্ভব এ কথা জানাতে হবে। না হলে খানিক বাদে তিনি কর্নেল জানজুয়ার হাতেই প্রাণটা হারাবেন। দূর থেকে ক্যাপ্টেন অলি যতটা সম্ভব আকারে ইঙ্গিতে মেজর জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি এই আকার ইঙ্গিতের ভাষা ঠিক বুঝলেন কিনা বোঝা গেল না।
এর মধ্যে কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াকে নতুন দায়িত্ব দিয়েছে। সেই দায়িত্ব পালনে মেজর জিয়াউর রহমান লেফটেন্যান্ট আযমকে সাথে নিয়ে বিগ্রেডিয়ার আনসারীকে রিপোর্ট করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে রওনা দিলেন। কর্নেল জানজুয়া মেজর শওকতকে সাথে নিয়ে তাঁর জিপ গাড়িতে উঠে বাসার দিকে চলে গেল।
ক্যাপ্টেন অলি বুঝতে পারলেন তাঁর বুকের মধ্যে হার্টবিট অনেকখানি বেড়ে গেছে। তরুণ বয়সেও এই উত্তেজনা আর টেনশন তিনি নিতে পারছেন না। মনে মনে তিনি একজন লোককে খুঁজছেন যে খুব দ্রুত মেজর জিয়াউর রহমানকে ধরে ফেলে তাঁকে সঠিক সংবাদটা দিতে পারবে।
শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন অলি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের দেখা পেলেন। খালেকুজ্জামান নিজেই কয়েকজন সৈন্য নিয়ে মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত রওনা দিলেন। ক্যাপ্টেন অলি ডেকে পাঠালেন নায়েব সুবেদার আব্দুল হামিদকে। আব্দুল হামিদকে অর্ডার দিলেন অস্ত্রাগার খুলে সমস্ত অস্ত্র বাঙালি অফিসারদের হাতে দিয়ে দেওয়ার জন্য।
ওদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাস্তা দিয়ে যে ট্রাকটি চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে ছুটে চলেছে সেটি নৌবাহিনীর একটি ট্রাক। ট্রাকের মূল আরোহী মেজর জিয়াউর রহমান আর লেফটেন্যান্ট আযম। ট্রাকের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নৌ সেনারা সতর্ক নজর রাখছে। যদিও বেশ কিছু বাঙালি সৈন্য ট্রাকে রয়েছে। কিন্তু মেজর জিয়া রয়েছেন অস্বস্তির ভেতর। তিনি আড়চোখে বারবার লেফটেন্যান্ট আযমকে দেখছেন আর শুধু ভাবছেন, এরা তাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? এদের কী অন্য কোনো প্ল্যান আছে? কী করতে চাচ্ছে এরা?
এসব ভাবনার মধ্যেই জিয়াউর রহমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। রাস্তার মধ্যে জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড দেওয়া। সবচেয়ে বড় ব্যারিকেড যেটা দেওয়া হয়েছে সেটা আগ্রাবাদের রাস্তায় দেওয়ানহাটের দিকে। ট্রাক আগানোর কোনো বুদ্ধি নেই। সৈন্যরা তাই ট্রাক থেকে নেমে ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত। মেজর জিয়া ট্রাক থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলেন। খুব অস্থির লাগছে তার। মেজর জিয়াউর রহমানের এই অস্থিরতার মধ্যে হঠাৎ করে কয়েকটা গাড়ি ছুটে এল তাদের নৌবাহিনীর ট্রাকটার দিকে। একটা গাড়ি থেকে প্রায় লাফ দিয়ে নেমে এলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।
খালেকুজ্জামানকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেশ উত্তেজিত। কোনোভাবেই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছেন না। উত্তেজিত অবস্থাতেই তিনি জিয়াকে রাস্তার একপাশে ডেকে নিয়ে কানে কানে বললেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা তো রাস্তায় নেমে পড়েছে। যেখানে যাকে পাচ্ছে গুলি করছে। বহু লোক মারা গেছে। অনেকে ইনজুরড। কী করবেন এখন?’
মেজর জিয়া সব মিলে ৩০ সেকেন্ডের মতো ভাবলেন। ৩০ সেকেন্ড! তিনি সাধারণত চিৎকার করে কথা বলেন না। কিন্তু ৩০ সেকেন্ডের ভাবনা শেষ করেই জিয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘উই রিভোল্ট!!’
এরপরের গল্পটা শুধুই আমাদের, এর পরের গল্পটা সেই অবিসংবাদিত ঘোষণার, পরের গল্পটা ফাঁসির স্বস্তি মাথায় তুলে নিয়ে দেশ বাঁচাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মেজর জিয়া শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই যে ক্ষান্ত ছিলেন তা নয়। তিনি লড়াই করেছেন, অংশ নিয়েছেন সমর যুদ্ধে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক