বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাংলা ভাষার জন্য হুগলির প্রশান্ত মিত্রের ২২ বছরের লড়াই

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলা ভাষার জন্য হুগলির প্রশান্ত মিত্রের ২২ বছরের লড়াই

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলির বৈদ্যবাটিতে জন্ম নেওয়া প্রশান্ত কুমার মিত্র কর্মজীবনে ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। দাফতরিক কাজে ইংরেজির বহুল ব্যবহার থাকলেও নিজে থেকে কোনো আবেদন করা কিংবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দিতেন। শুধু তাই নয়, সবাই যখন গাড়ির নম্বর প্লেট ইংরেজিতে লাগাতেন তখনও তার গাড়িতে শোভা পেত বাংলায় লেখা নম্বর প্লেট।

শুধু কি তাই! নিজ এলাকায় ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা, শহীদদের স্মরণ করার জন্য চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার রীতিমত আন্দোলন শুরু করেন প্রশান্ত মিত্র। শুরুতে ‘বাংলা ভাষা পাগল’ বলেও অনেকে আড়ালে বলত। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেকটা সফল হতে শুরু করেছেন বাংলা ভাষাপ্রেমী এই মানুষটি। কারণ বৈদ্যবাটিসহ আশপাশে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণ করছেন অনেকে। এই আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পেছনে থেকে কাজ করা মানুষটি প্রশান্ত মিত্র।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতা থেকে এলেন তারা ২৪ জন

পশ্চিম বাংলার প্রধান ভাষা বাংলা। প্রশান্ত মিত্রের স্বপ্ন সবাই যেন মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার না করে বাংলাতেই কথা বলেন। তাই বাংলাকে ভালোবেসে প্রশান্ত মিত্র ২০০০ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর যে লড়াই করেছেন সে পথে হাঁটতে গিয়ে বাংলাদেশের শহীদ মিনারের প্রেমে পড়ে যান তিনি। এখানে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে নিজেকে শামিল করার সুপ্ত বাসনা পেয়ে বসে তাকে। কিন্তু বয়স ৮০ ছাড়িয়ে যাওয়া এই মানুষটির একার পক্ষে তা সম্ভব না। আবার করোনায় ঘরবন্দি থেকে শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থও গিয়েছেন তিনি। তাই মেয়ে উপমা চ্যাটার্জিকে স্বপ্নপূরণে পাশে চাইলেন।

নাছোড়বান্দা বাবার এই ইচ্ছেপূরণ করতে গত ডিসেম্বর থেকে মাঠে নামেন উপমা। বাবা-মায়ের পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে সব প্রস্তুতি শেষ করে গত সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) পা রাখেন বাংলাদেশে। মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মেয়ের হাত ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছান তারা তিনজন।


বিজ্ঞাপন


hugli2

ঠিক বেলা ১টার দিকে হুগলির এই পরিবারের সদস্যরা যখন শহীদ মিনারে পৌঁছান তখন প্রচণ্ড ভিড়। তাই পুলিশের সহযোগিতায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ফুল হাতে শহীদ বেদীতে যাওয়ার সুযোগ পান তারা। পরে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা ভাষা শহীদদের প্রতি জানান অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

আরও পড়ুন: ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগে আবেগাপ্লুত ভিনদেশিরাও

শুধু তাই নয়, প্রশান্ত মিত্রর অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা মঞ্জুশ্রী মিত্র লেখা ‘কবিতা নিয়ে’ বই থেকে বাংলা ভাষা নিয়ে লেখা কবিতাও আবৃত্তি করা হয় শহীদ মিনারের ঘোষণা মঞ্চ থেকে। আর শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি ফুটেছে প্রশান্ত-মঞ্জুশ্রী দম্পতির মুখে। অন্যদিকে বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে পেরে আনন্দে ভাসছেন মেয়ে উপমা চ্যাটার্জি।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার নাম প্রশান্ত মিত্র। ইচ্ছাপূরণ হওয়ার পর তিনি খুশিতে বলছেন- এখন আমার প্রশান্তি লাগছে। সন্তান হিসেবে এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু নেই।’

টিপ্পনিও দমাতে পারেনি প্রশান্ত মিত্রকে

উপমা চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তার বাবা যখন সবাই যেন বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাংলার প্রচলন যেন বেশি হয় সেজন্য চেষ্টা শুরু করেন, তখন অনেকে টিপ্পনি কাটত। কারণ হুগলিতে বাংলায় কথা বললেও অনেকে মিশ্রিত ভাষায় কথা বলেন। কেউ হয়ত বাংলার সঙ্গে ইংরেজি, কেউ আবার হিন্দি যুক্ত করে কথা বলেন। যে কারণে শুরুতে আশপাশের অনেকে প্রশান্ত মিত্রের লড়াইকে ভালোভাবে নেয়নি।

উপমা বলেন, ‘বাবাকে নিয়ে অনেকে দূরে বসে বলত বাংলা বাংলা করতে করতে বুড়ো পাগল হয়ে গেল। আরও অনেক কিছু বলতেন। কিন্তু তিনি এগুলো কিছু আমলে নেননি। আমাদের বাংলায় নম্বর প্লেট লেখা গাড়ি দেখলেও লোকজন নানা কথা বলত।

উপমা জানালেন, তার বাবা যখন ট্রেনের টিকিট বুক করতে যেতেন তখন উল্টো পাশে বাংলায় লিখে দিতেন।

প্রশান্ত মিত্র যেভাবে বাংলাদেশের শহীদ মিনারে

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসার আগ্রহের কথা বলছিলেন প্রশান্ত মিত্র। গত ডিসেম্বরে মেয়ে উপমা চ্যাটার্জি বাবার ইচ্ছেপূরণের জন্য নেমে পড়েন। দ্রুততার সঙ্গে সবার পাসপোর্ট তৈরি করলেন। বাবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় দ্রুত ভিসাও পেয়ে যান। পরে মৈত্রী এক্সপ্রেসে চেপে যাত্রা শুরু করেন বাংলাদেশে।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় নেমে কমলাপুরে একটি হোটেলে বাবা-মাকে নিয়ে ওঠেন উপমা চ্যাটার্জি। নিজে ঘুরতে পছন্দ করেন, তাই পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আগে থেকে টেলিফোনে হোটেলে রুম বুকিং করে রেখেছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি সকালে হোটেল থেকে বাবা-মাকে নিয়ে রওনা হন শহীদ মিনারের উদ্দেশে। বেলা ১টার দিকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ক্লান্ত শরীরে আবার ফিরে যান হোটেলে। এরমধ্য দিয়ে ২০০০ সাল থেকে বাংলা ভাষার জন্য কাজ করা প্রশান্ত মিত্র লাভ করেন অন্যরকম তৃপ্তি।

প্রশান্ত কুমার মিত্র ঢাকা মেইলকে বলেন, `বঙ্গভাষার টানে চলে এসেছি। এসে এত মানুষের উপস্থিতি দেখে ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। জীবনে ইচ্ছে ছিল এখানে এসে শহীদ প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো। সেটা পূরণ হলো।’

hugli3

২৩ ফেব্রুয়ারি সৌহার্দ্য পরিবহনে বাসে করে নিজ দেশে ফিরবে প্রশান্ত কুমার মিত্রের পরিবার। তবে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন অল্প সময়ের বেশ কিছু স্মৃতি। শ্রদ্ধা নিবেদনের বাইরে অবশ্য ঢাকেশ্বরী মন্দিরও ঘুরে এসেছেন তারা।

স্বরচিত কবিতা পাঠে উৎফুল্লু মঞ্জুরী মিত্র, আতিথেয়তায় মুগ্ধ উপমা

অল্প সময়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে উৎফুল্ল প্রশান্ত মিত্রের পুরো পরিবার। দেশে থাকা স্বজনদের ক্ষণে ক্ষণে জানিয়েছেন এখানকার সবকিছু। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে মঞ্জুরী মিত্রের নিজের লেখা কবিতা শহীদ মিনারের ঘোষণা মঞ্চ থেকে আবৃত্তির কারণে।

‘কবিতা নিয়ে’ বইটিতে অর্ধশতাধিক কবিতা লিখেছেন চারুশিলা বোস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার সাবেক শিক্ষক মঞ্জুশ্রী মিত্র। ২০০৫ সালে অবসরে গেছেন তিনি। বাংলা ভাষায় লেখা কবিতার বইয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে কবি শামসুর রহমানদের নিয়েও আলাদা কবিতা আছে।

আরও পড়ুন: বাংলাই বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ভাষা নিয়ে তার কবিতার তথ্য ঘোষণা মঞ্চে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে দুইবার আবৃত্তি করা হয় কবিতাটি। যা সত্যি অবাক করেছে এই শিক্ষককে।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমি অনেক আনন্দিত। আবার আমার কবিতা পড়ে শোনালেন যারা তারা তো অবাক করে দিয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আসার পর থেকে যার সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে সবাই খুব সহযোগিতা করছে। মনে থাকবে সবার কথা।’

আর তাদের মেয়ে উপমা চ্যাটার্জি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাবার ইচ্ছেপূরণ করতে পেরেছি এর চেয়ে বড় শান্তির কিছু নেই। মাতৃভাষার প্রতি অনুভুতি, এত দরদ, এত আবেগ এখানে এসে দেখলাম। এখানকার মানুষ সেই শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এটা দেখে বুঝলাম। আমার কাছ থেকে শুনে হুগলি থাকা স্বজন ও বন্ধুরাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। তারাও হয়তো আগামীতে আসবে। বাবা-মা দুজন আবেগাপ্লুত। তারা বলছেন, এই যাত্রায় তারা ধন্য হয়েছেন। আমার জার্নিটাও সম্পূর্ণ হলো।’

কী স্মৃতি নিয়ে ফিরছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানকার মানুষের ব্যবহার, আন্তরিকতা ভুলবো না। শুধু ফোন করেছে হোটেলের লোকজন রুম বরাদ্দ করে রেখেছে। অটো চালক থেকে শুরু করে হোটেল, রেস্টুরেন্ট যেখানে গিয়েছি সবার ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ হয়েছি। সুযোগ পেলে সবাইকে নিয়ে আবার আসবো বাংলাদেশে।’

বিইউ/জেবি

 

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর