বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাংলায় রায় দেওয়ার ‘বাধা’ কাটছে

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫৭ এএম

শেয়ার করুন:

বাংলায় রায় দেওয়ার ‘বাধা’ কাটছে
প্রতীকী ছবি

আইন ও আদালতের ভাষা সহজবোধ্য নয়। আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা আদালতের ভাষা সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের কাছে দুর্বোধ্য। তারা সহজে আদালতের রায় বুঝতে পারেন না। এর ফলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। এমনকি উচ্চ আদালতের ভাষা বুঝতেও বার বার যেতে হয় আইনজীবীর কাছে। অথচ এ ভাষার জন্য আন্দোলন ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলা ভাষা যদি সর্বত্র চালুই না করা যায়, তাহলে কেন জীবন দিয়েছিলেন রকিক, সালাম, জব্বার, বরকত? এমন প্রশ্নের উত্তর মেলা কঠিন। তবে আশার দিক হলো- বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ ঘোষণা শুরু করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারপতি।

গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখা শুরু হয়েছে। এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে চালু হয়েছে আলাদা শাখা।


বিজ্ঞাপন


প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীরা যাতে আদালতের রায় বুঝতে পারেন, সে জন্য ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করতে সুপ্রিম কোর্টে যুক্ত হয়েছে নতুন সফটওয়্যার ‘আমার ভাষা’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ সফটওয়্যার দিয়ে রায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করা যাবে।

বিচার বিভাগের প্রধান আরও বলেন, আমাদের মহান ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তারা যে চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন, আমাদেরও সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে।

এ বছরও বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া শুরু করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বেশ কয়েকজন বিচারপতি। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দেড় শতাধিক রায় ও আদেশ বাংলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন বিচারপতিরা। এদিন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ১৪৫টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। আদেশ দেওয়ার সময় তিনি জানিয়েছেন, এখন থেকে চেম্বার আদালতে বাংলায় আদেশ দিয়ে যাবেন। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নাইমা হায়দার একটি রায়, বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম ইসলাম তালুকদার একটি, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল একটি এবং বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন।

বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার বিষয়টিকে প্রশংসনীয় উদ্যোগ উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, এসব রায় ও আদেশ বিচারপ্রার্থীদের কাজে লাগবে।


বিজ্ঞাপন


ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘মো. আক্কাস আলী বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়টি বাংলায় ঘোষণা করা হয়।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি রিভিশন মামলায় রুল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে বাংলায় রায় ও আদেশ দেন।

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ একটি আদেশ দিয়েছেন।

বাংলায় দেওয়া আদেশে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সড়কের পাশে লাগানো অর্ধশত তালগাছ মেরে ফেলার জন্য কীটনাশক প্রয়োগকারী স্থানীয় শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহরিয়ার আলমকে তলব করেছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, চাইলে রাতারাতিই আদালতের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব। এটা জনগণকে ভয়াবহভাবেই চাইতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

GG

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের যে স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আমরা বলছি আমাদের আইন বাংলায় হতে হবে। যখন বাংলা ভাষা বিশ্বের ভাষা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে ওঠেনি।

সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কেন তার শাস্তি হচ্ছে বা ফাঁসি হচ্ছে। এটা বোঝার জন্য তাকে আইনজীবীকে অতিরিক্ত ফি দিয়ে বুঝতে হয়। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আছে, সেখান থেকে যদি বলে দেয়, আজ থেকে নিম্ন আদালত বাংলায় রায় দেবে, তাহলে তো আর আইন করা লাগে না।

তবে আদালতের রায় বাংলা ভাষায় দিলে অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করবে বলে মত দিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।

তিনি বলেন, বাংলা আমাদের আবেগের ভাষা। এ ভাষার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার আছে জাতির। তবে আদালতের ভাষা ও আইন যদি বাংলায় করা হয় সেটি হবে অনেক সমস্যার কারণ। কারণ আমাদের দেশে এখনো আইনের বাংলা ডিকশনারি নেই। ডিকশনারি না থাকলে শব্দ বোঝা যাবে না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। আমরা যদি ইংরেজি না জানি তবে বিশ্বে পিছিয়ে থাকব। যারা এ দেশ থেকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে যায় তাদের ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক। ব্যারিস্টারি পড়ে বা বিদেশে পড়ালেখা শেষে অনেকেই আইন সম্পর্কে ভালো দক্ষতা অর্জন করেন। এজন্য আদালতের ভাষা বাংলা হলে টেকনিক্যালি আমাদের সমস্যা হবে। এমনিতেই আমরা  পিছিয়ে আছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ আইনই ব্রিটিশদের হাতে প্রণয়ন করা। আইনের বিভিন্ন টার্ম ব্রিটিশরা তাদের ভাষায় করে গেছে। আদালতও সেগুলো পালন করে আসছে আগে থেকেই। তবে বাংলা ভাষায় রায় বা আদেশ দেওয়া এখন দেশের সাধারণ মানুষের দাবি।

এআইএম/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর