১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার জন্য রাজপথে নেমে আন্দোলন করেছিলেন—সেই নবম শ্রেণির কিশোর ফজলুল হক এখন ৮৪ বছরের বৃদ্ধ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটা এখন আর আগের মতো ছুটে চলে না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাড়িতে শুয়ে-বসেই কাটে তার পুরো সময়। নাটোর জেলায় যে কয়েকজন ভাষাসৈনিক ছিলেন, তাদের মধ্য ফজলুল হক শুধু জীবিত রয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনে নাটোরের রাজপথে মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পেরিয়ে গেলেও মেলেনি তাঁর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আজও স্বীকৃতির আশায় তাকিয়ে রয়েছে তিনি।
বিজ্ঞাপন
১৯৩৮ সালে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার দমদমা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন ফজলুল হক। পরিবারে স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক তিনি। বর্তমানে নাটোর শহরের কান্দিভিটা এলাকায় নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন।
জানা গেছে, ৫২’র ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রক্তাক্ত হয়ে উঠে ঢাকার রাজপথ। এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে মিছিল ও সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে নাটোরের রাজপথ। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন নাটোরের ভাষাসৈনিক ফজলুল হক। তিনি তখন তৎকালীন জিন্নাহ মেমোরিয়াল বয়েজ হাই স্কুলের (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে স্কুলে গিয়ে সকল ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে পরামর্শ সভা করেন তিনি।
সভায় সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশ গ্রহণে শহরে মিছিল ও সমাবেশ হয়। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সকল ক্লাস ক্যাপ্টেন নিয়ে প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এর কাছে মিছিল করার অনুমতি চান। অনুমতি পেয়ে স্কুলের প্রায় দেড়শ’ শিক্ষার্থীর মিছিলটি অংশগ্রহণে করেন।
শহরের আলাইপুর হয়ে নাটোর গার্লস হাইস্কুলে(বর্তমানে নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) পৌঁছায়। এরপর বাঁধ সাধেন স্কুলসহ দুইটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ধ্বনিতে ‘রাষ্ট্র্রভাষা বাংলা চাই’স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহরের রাজপথ। মিছিলটি শহরের লালবাজার হয়ে মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ হাইস্কুলে গিয়ে পৌঁছায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরিজাশংকর চৌধুরীর অনুমতি পেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌথ মিছিল বের করে। শহরের কাপুড়িয়াপট্টির পথ ধরে মিছিলটি চৌধুরী বাড়ির আম বাগানে পৌঁছায়। আন্দোলন-সংগ্রামের সমাবেশ কেন্দ্র ছিল এ আম বাগান।
শিক্ষার্থীদের এ সমাবেশে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রখেন- বরেণ্য সাহিত্যিক ও পরে নাটোর পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট জিয়াউল হক, দৌলতুজ্জামান, ফজলুল হক শাহ, মহারাজা স্কুলের ক্যাপ্টেন তরুণ রায়সহ অনেকে।
বিজ্ঞাপন
হঠ্যৎ সমাবেশ চলাকালীন সময়ে পুলিশ আসলে আতংক ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশে। গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন ফজলুল হক। আন্দোলনকারীদের নামে পুলিশ হুলিয়া জারি করেছে। তাই ফজলুল হকেরসহ কয়েক জন এক সপ্তাহের জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এ খবর গুজব জানতে পেরে তাঁরা ফিরে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এবং তমদ্দুন মজলিশের সহযোগিতায় শহরে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে কর্মসূচির পোস্টার, মাইকিংসহ প্রচারণার মূল দায়িত্ব পালন করেন ফজলুল হকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী।
ভাষাসৈনিক ফজলুল হকের ছেলে ওয়াসিফ-উল-হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বাবা ভাষা অন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যা আমাদের জন্য গৌরব ও অহংকারের বিষয়। কিন্তু আমার বাবা আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। বাবা এখনও স্বীকৃতির আশায় পথ চেয়ে আছেন। সরকার যদি স্বীকৃতি প্রদান করে তাহলে বাবার শেষ স্বপ্না পূরণ হবে। বাবা এখন অনেক অসুস্থ্য। তিনি হাঁটা-চলা করতে পারেন না। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন।
ভাষা সৈনিক ফজলুল হক বলেন, বছরে ফ্রেব্রুয়ারি মাস এলেই মনে পড়ে সেই ভাষা আন্দোলনের কথা। মাতৃভাষা জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সেদিন এতটুকু দ্বিধা করিনি। সেই আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে এখনও গর্ববোধ করি।
এ জীবনে কিছুই পাওয়ার নেই, শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। আশায় রয়েছি, মৃত্যুর আগে যদি রাষ্ট্র আমাকে সম্মাননা দিতেন।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মো. শামীম আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ভাষাসৈনিক ফজলুল হক অসুস্থ্য রয়েছেন। তার সুস্থ্যতা কামনা করছি। গত বছর তাঁকে জেলা প্রশাসন সম্মাননা প্রদান করেছিল। এবারও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ভাষাসৈনিক ফজলুল হককে নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয় ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত শতবর্ষ উৎসবে ভাষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রাখায় সম্মাননা প্রদান করেছে। জেলা বোর্ডের সেকশন অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি করেছেন তিনি। অবসরের পর ফজলুল হক নাটোর শহরে ওষুধ ব্যবসার সাথে সম্পূক্ত ছিলেন।
প্রতিনিধি/এইচই