সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নিউমার্কেট এলাকায় বারবার সংঘর্ষ, নেপথ্যে যত কারণ

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২২, ১২:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

নিউমার্কেট এলাকায় বারবার সংঘর্ষ, নেপথ্যে যত কারণ

রাজধানীর একটি ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা নিউমার্কেট। এই এলাকায় রয়েছে ঢাকা কলেজ, টিটি কলেজ (সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ), সিটি কলেজের মতো নামকরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায়ই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আবার কখনও কখনও শিক্ষার্থীদের নিজেদের সংঘর্ষের ঘটনা ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সড়কে গড়ায়। ব্যস্ততম এলাকাটি পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

সবশেষ সোমবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার দিনভর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ চলে। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত থাকলেও যেকোনো সময় আবার ঘটতে পারে অপ্রীতিকর ঘটনা।


বিজ্ঞাপন


dhaka-1এর আগে গত ৩০ মার্চ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ এবং টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর এক পর্যায়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (টিটি কলেজ) ভেতরে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ সাংবাদিক ও পথচারী আহত হন।

সম্প্রতি ঘটা দুটি অপ্রীতিকর ঘটনার পেছনে কী কারণ রয়েছে তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে ঢাকা মেইল। তাতে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার, ফ্রি খাওয়া, অর্ধেকেরও কম মূল্যে পণ্য কেনাসহ প্রেমঘটিত কারণেই ঘটে এসব ঘটনা। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ীর অসৌজন্যমূলক আচরণকেও এর জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুই কলেজের অন্তত দশজন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী এবং ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। ব্যবসায়ী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর প্রতিকার হিসেবে বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধই এর একমাত্র সমাধান। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক অপতৎপরতা কমানোর তাগিদও দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে হামলাকারী বা সংঘর্ষে যারা জড়ায় তাদের শিক্ষার্থী বলে প্রচার করা হয়। ফলে হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যারা তৎপর তাদের সামনে (শনাক্ত) আনা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

dhaka-6দুই ক্যাম্পাস শাখা ছাত্রলীগ নেতা এবং সমর্থকরা বলছেন, সামান্য বিষয় নিয়েই ব্যবসায়ীরা এগ্রেসিভ আচরণ করে বসেন। ফলে কম বয়সী শিক্ষার্থীদের (কর্মী) থামিয়ে রাখা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।


বিজ্ঞাপন


এসব সংঘর্ষের একটি বড় কারণ ঢাকা কলেজে দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা। এতে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে আছে শাখা ছাত্রলীগ। একটি গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও অন্যরা জড়িয়ে পড়ছে এমন হীন কাজে।

জানা যায়, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এই ইউনিটটি সরাসরি কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হলেও টিটি কলেজ ঢাকা মহানগর উত্তরের অধীনে। অবস্থানগত পাশাপাশি ক্যাম্পাস হওয়ায় আশপাশের আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া দুই কলেজের ছাত্রলীগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে তেলের পাম্প থেকে শুরু করে নিউমার্কেট এলাকার নিয়ন্ত্রণে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। সেখানকার সব ফুটপাত থেকে শুরু করে দোকানিদের ওপর জবরদস্তি এবং বিভিন্ন বিচার সালিশের দায়িত্ব তাদের। যেখানে ব্যবসা করতেও থাকতে হবে সংগঠনটির নেতাদের (কলেজ শাখা) সমর্থন। আবার নিউমার্কেট এলাকার একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় শাখা ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে।

dhaka-7অন্যদিকে সাইন্সল্যাব অংশ থেকে শুরু করে আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করে টিটি (টিচার্স ট্রেনিং কলেজ) কলেজ ছাত্রলীগ। প্রায়ই একে অপরের এলাকায় ঢুকে পড়েলেই ঘটে সংঘর্ষের মতো ঘটনা।  

ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম দানিস ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম, যাদের কারোরই ছাত্রত্ব নেই। এক বছর মেয়াদী কমিটি হলেও পার হতে চলছে চার বছর। দুজনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন। দানিস ডেপুটি ট্যাক্স অফিসার এবং রিয়াজুল রেভিনিউ সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিএড এবং এমএড নামে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে দুটি আবাসিক হল রয়েছে।

এমএড হলের ২০০৬নং কক্ষে সভাপতি এবং ৩০০২নং কক্ষে সাধারণ সম্পাদক থাকেন। এই কলেজটিতে আবাসিক শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই থাকেন বাইরে। এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাসে দুই হাজার ৩০০ থেকে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন বহিরাগতরা।

অন্যদিকে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ কমিটির অবস্থা আরও নাজুক। বছরের পর বছর কমিটি নেই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের। এরপরও ঢাকা কলেজে দাপট কমেনি ছাত্রলীগের। অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, তাদের ক্যাম্পাসমুখী হতে দেন না ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে চাইলেও তাদের বাধা দেওয়া হয়। আবাসিক হল থেকে কর্মসূচি– ঢাকা কলেজে সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাকিরা সবাই কোণঠাসা।

dhaka-4সংশ্লিষ্টরা জানান, কলেজ ক্যাম্পাসে কর্মসূচিতে সবচেয়ে সক্রিয় ছাত্রলীগ। আবাসিক হলের সিট বরাদ্দে তারা আলাদা কোটা পায়। এখন আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। হলগুলো উত্তর-দক্ষিণ ব্লকে ভাগ করে প্রায়ই নেতাকর্মীরা সংঘাতে জড়াচ্ছেন।

২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। পরদিন কমিটি স্থগিত করা হয়। এর তিন বছর পর ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিন মাসের জন্য নুর আলম ভূঁইয়া রাজুকে আহ্বায়ক করে কমিটি অনুমোদন দেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন।

২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ শাখার ঢাকা কলেজে ছাত্ররাজনীতি আহ্বায়কসহ ১৯ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় সংগঠন। এরপর তিন মাসের সেই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে ছাত্রলীগের কার্যক্রম। এই কমিটিতে ২৮ জন যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৯০ জন সদস্য রয়েছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজ শাখার নেতৃস্থানীয় তিনজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তারপরেও কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয় না। ফলে ছাত্রলীগ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে।

dhaka-2

এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাবার খেয়ে টাকা না দেওয়া, জোর করে পণ্য নিয়ে যাওয়া, ঈদের সালামি বা নানা অজুহাতে বকশিশ দাবি করার রীতি থেকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী বাবু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের এই টেনডেন্সি থেকে বের হয়ে আসতে হবে- ফাও খাওয়া, বিনা টাকায় জোর করে নিয়ে যাওয়া, ঈদের বকশিস, সালামি। আপনি একটা দোকানে খাবেন, কিন্তু টাকা দেবেন না- এটা কোনো কথা হলো? ১০০০ টাকার জিনিসটা আপনি ২০০ টাকা দিয়ে চলে যাবেন?’

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ জুলফিকারকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগে কমিটি এবং শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সঙ্গে বাকবিতণ্ডার বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

dhaka-8
নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এমন ঘটনা শিক্ষার্থীরা ঘটিয়েছে বা সূত্রপাত করেছে তা নয়। এই ঘটনার সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি। এখানে কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের ঢাকা কলেজের পরিচয় এবং রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু ব্যবসায়ী চাইলেই এসব ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারেন। দুই পক্ষেরই দোষ রয়েছে।’

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘আমাদের দোকানগুলোতে সব শ্রেণির ক্রেতা আসেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুই পক্ষ সীমালঙ্ঘন করে। সাধারণ শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ ব্যবসায়ীরা কখনোই গোলমালে যাবে না। যারা নিজেদের অসাধারণ ভাবতে শুরু করেন, তারাই এমন করেন। তারা আসে সামান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়, এরপর তারা সংঘর্ষে জড়ায়।’

ডিএইচডি/জেবি 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর