প্রতিবেশী ইউক্রেনের পশ্চিমা ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেনি রাশিয়া। নানা হুমকি ধামকির পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে হামলা চালায় মস্কো। তারপর থেকে থেমেথেমে চলা এই যুদ্ধ এখন রাশিয়া ও পশ্চিমাদের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এটি শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধ পাল্টে দিচ্ছে বিশ্বের ভূ-রাজনীতির হিসেব-নিকেশ।
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে। প্রায় ৯ লাখ ইউক্রেনীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ।
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়াকে নিজেদের দেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়া। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলার পর সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ চার অঞ্চলকে শুরুতে স্বাধীন ঘোষণা দেয় ক্রেমলিন। সম্প্রতি গণভোটের মাধ্যমে এই অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেনকে ঘিরে এই সংঘাতের শুরু কখন থেকে? সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০১৪ সালে এটি শুরু হয়েছে। যদিও এই সংকটের আসল কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরো পেছনে- সোভিয়েত আমলে, যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। পূর্ব ইউরোপের আরও কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো, ইউক্রেনেও দুটি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট।
একটি অংশ চায় পশ্চিম ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। অপর অংশ রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতী, কারণ ইউক্রেনের জনসংখ্যার বিরাট অংশ রুশ ভাষাভাষী, তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সাথে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক যোগাযোগ।
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিক্ষোভের মুখে। এরপর তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।
ইউক্রেনের ভেতরে যে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চল, সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে মস্কো তাদের সমর্থন দেয়। এই বিদ্রোহীদের সমর্থনে এরপর রুশ সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করে, এক পর্যায়ে ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে সেটি নিজেদের দেশের অংশ বলে ঘোষণা করে রাশিয়া।
এছাড়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া সম্প্রতি যেসব অভিযোগ এনেছে তা হলো ন্যাটোতে যোগদান। পুতিন বলেছেন, ন্যাটো পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করে রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এছাড়া সেখানে সেনা সংখ্যাও বাড়িয়েছে। রুশ হামলায় বিপর্যস্ত ইউক্রেনের বিশাল অঞ্চল। শীতে এসব অঞ্চলের মানুষ দুর্বিষহ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন।
যুদ্ধের শুরুতে রুশ সেনারা দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগোলেও এখন তা অনেকটা বিমান হামলা নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিশেষ বিশেষ অঞ্চল থেকে রুশ সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি রুশ সেনাদের বিপরীতে বড় জয়ের দাবি করেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ও আক্রমণ প্রতিহত করতে ইউক্রেনকে দুই হাত খুলে সাহায্য করছে পশ্চিমারা। মানবিক, কাঠামোগত উন্নয়ন ও সামরিক সহায়তার বড় বড় প্যাকেজ ঘোষণা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে ভলোদিমির জেলেনস্কি সরকার।
যুদ্ধ শুরু পর ইউক্রেন প্রথম যে কাজটি করেছে সেটি হলো দ্রুত ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন। এছাড়া পশ্চিমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন জেলেনস্কি। তবে ন্যাটো জানিয়েছে, এই প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ এবং ইউক্রেনকে এর অংশ করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা সরাসরি জানিয়েছে যে, রাশিয়ার হামলায় ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ও হামলা প্রতিহত করতে সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া হলেও তারা কোনোভাবেই যুদ্ধে অংশ নেবে না।
ইউক্রেনের হামলার কারণে পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে রাশিয়া। তবে এর মধ্যেও তেলের দাম কমিয়ে বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে তারা। অন্যান্য ব্যবসাও ডলারবিহীন করার উপায় বের করেছে পুতিন সরকার। এসব নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় প্রস্তুত বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
চলমান কঠিন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনকে সহায়তা এবং রুশ আগ্রাসনকে প্রতিহত করার সংগ্রামে ইউরোপ একতা, দৃঢ়তা ও নীতিগত ইচ্ছা পোষণ করেছে; কিন্তু এটি অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। কারণ, আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২৩ সালকে মনে করা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ইউরোপের সক্ষমতা পরীক্ষার বছর।
বৈশ্বিক জ্বালানি ব্যবস্থার পুনর্গঠন, যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক ফাটল ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতামূলক উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলছে। এটি কেবল মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
পশ্চিমারা ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও সামরিক সহায়তার মাত্রা বাড়িয়েছে। সেই হিসেবে এখন রাশিয়া ইউক্রেনসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে লড়ছে, যার ফলাফল এখনো অনিশ্চিত।
একে