বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ঢাকা

কপ-২৭ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

কপ-২৭ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশসহ অন্য গরিব দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে ঐতিহাসিক ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

মিসরের শার্ম-আল-শেখে ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর গভীর রাতে সংস্থার প্রেসিডেন্ট সামি শৌকরি চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা দেওয়ার পর সম্মেলন কক্ষ করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে। এবারের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে গরিব দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে ব্যাপক দেন-দরবার চলছিল।


বিজ্ঞাপন


তবে চুক্তি অনুসারে ধনী দেশগুলো কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে আর ক্ষতিগ্রস্তরাই বা কিভাবে ক্ষতিপূরণ পাবে তার বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি।

এই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ টার্মটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোকে সহায়তায় একটি তহবিলের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখায় দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে- এই ভয় থেকেই ধনী দেশগুলো গত ৩০ বছর ধরে ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনায় বাধা দিয়ে আসছিল।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি অনেক বদলে যায় এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষয়ক্ষতির ইস্যুটি মিসরের সম্মেলনে প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়।


বিজ্ঞাপন


মিসরের শারম-আল-শেখে ৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয় ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন, যার আনুষ্ঠানিক নাম কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৭ বা কপ-২৭।

সম্মেলনে অংশ নেন ১৯৮টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। সেখানে জাতিসংঘ যেমন ছিল, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও পরিবেশ কর্মীরাও ছিলেন।

সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে তহবিল গঠন করার বিষয়ে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখতে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হয়নি। ফলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঝুঁকিতে থাকা দেশ এবং পরিবেশ কর্মীরা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ধনী দেশগুলোর নিঃসরণ করা কার্বনের কারণে তৈরি হওয়া এই তহবিলের টাকা দিয়ে তারা ঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজে লাগাবে।

যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এদিকে সমঝোতা হলেও তহবিলে কোন দেশ, কীভাবে আর কত টাকা দেবে সেসব বিষয় এখনও পরিষ্কার হয়নি। আগামী বছরের আগে সেই উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে বিতর্ক
ইউরোপে যুদ্ধ, জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা এবং বিশ্বজুড়ে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার একটি পরীক্ষা হিসেবে দেখা হয়েছে দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই সম্মেলনকে।

মিসরের এই সম্মেলন আখ্যা পেয়েছে ‘আফ্রিকান কপ’ হিসেবে। ধনী, শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের ফলে গরীব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ এবং ক্ষতির মধ্যে পড়েছে, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার  প্রতিশ্রুতি দিয়েই সম্মেলন শুরু হয়েছিল।

কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি ইস্যুতে কোনো উল্লেখযোগ্য সমাধান হয়নি। উন্নত দেশগুলো বিশ্ব থেকে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো তাতে রাজি নয়।

বহু দরকষাকষির পর আলোচনা ঠেকেছিল একেবারে বাতিল করার পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনা। কিন্তু ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশ এখন চাইছে, জীবাশ্ম জ্বালানি সীমিত করার তালিকায় কয়লার সঙ্গে যেন তেল-গ্যাসও যুক্ত করা হয়। এ নিয়ে বিতর্কে এই সম্মেলনে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেনি বিশ্বের দেশগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের বিপদ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো ঠিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য গত বছর একটি মন্ত্রণালয় গঠন করেছে বাংলাদেশের সরকার। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিশিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় করা হয়েছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে বাংলাদেশের হয়তো খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ সমস্যাটা তো বৈশ্বিক। সেটার সমাধানের জন্য উন্নত দেশগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যারা কাজ করেন, সেই অ্যাকটিভিস্ট এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যরা বলছেন, দশ বছর আগের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিষয়ে এখন সচেতনতা অনেক বেড়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারণেও তার প্রভাব পড়ছে। যেমন একসময় কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ওপর গুরুত্বারোপের নীতি নেওয়া হলেও এখন বাংলাদেশ তা থেকে সরে এসেছে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে এখনও বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ড. আতিক রহমান বলেন, আমাদের এখানে এখন দুর্যোগ বেশি হচ্ছে, নদী ভাঙন বাড়ছে, বেশি বেশি ঝড়, বন্যা হচ্ছে। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে শুষ্কতা তৈরি হচ্ছে আর দক্ষিণবঙ্গে লবণাক্ততা বাড়ছে। এসব কিছুই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।

অ্যাকটিভিস্টদের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ৬৫ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। যেভাবে উষ্ণতা বাড়ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে তিন থেকে চার কোটি মানুষ বাস্তুহারা হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ড. রহমান বলেন, আমেরিকা, চীনের মতো দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ না কমালে, পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশগুলোর পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যত কার্বন নিঃসরণ হয়, সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর দায় খুবই সামান্য।

এ কারণেই সংকট মোকাবেলায় তহবিল বরাদ্দ ও সেটার ব্যয়ের ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সাল পর্যন্ত ক্ষতির শিকার দেশগুলোর জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও সেই অর্থ পুরোপুরি পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেছেন, পরিবেশ উন্নয়নে তারা বৃক্ষরোপণ, উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনি তৈরি করছেন। পাশাপাশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষজনের জন্য নানা প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহায়তা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত পৈতৃক ভিটে মাটি ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের কারণে এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

জাতিসংঘের যেসব চ্যালেঞ্জ
জাতিসংঘের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। সংস্থাটির এই বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনও তাপমাত্রা সেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ধরে রাখার মতো অবস্থায় নেই। বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক বছরে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। কপ-২৬ সম্মেলনে থেকে তারা বলেছিল, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করবে। কিন্তু গত এক বছরে সেরকম অগ্রগতি দেখা যায়নি।

চীন ও ভারতের আপত্তির মুখে গত বছর কয়লা ভিত্তিক জ্বালানি থেকে পুরোপুরি সরে যেতে পারেনি বিশ্ব।

কী ঘটবে ভবিষ্যতে?
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।

অনেক বিজ্ঞানীর আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাহলে এর প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। যেমন-
১. ব্রিটেনে বৃষ্টিপাতের মাত্রা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়ে ঘনঘন বন্যা হবে।
২.সাগরের উচ্চতা বেড়ে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ছোট অনেক দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র বিলীন হয়ে যেতে পারে।
৩. আফ্রিকার অনেক দেশে খরার প্রকোপ বাড়তে পারে এবং পরিণতিতে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
৪. অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত গরম পড়তে পারে এবং খরার প্রকোপ দেখা দিতে পারে।

এমইউ/একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর