২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে পড়েছে। এরমধ্যে গ্যাস বা জ্বালানি সংকট ছিল চরমে। এই গ্যাস সংকটের কারণে বছরজুড়েই দেশের শিল্প খাতে টালমাটাল অবস্থা দেখা যায়। কমে যায় শিল্পের উৎপাদন। আর উৎপাদন কমার কারণে কমেছে পণ্য রফতানি ও রফতানি আয়ও। এতে বহির্বিশ্বে বাজার সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। রফতানি আয় কমার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ে দেশের রিজার্ভের ওপর।
গ্যাস সংকটে গত ২১ জুন থেকে বন্ধ ছিল যমুনা সার কারখানার উৎপাদন। ছয় মাস পর ২০ ডিসেম্বর উৎপাদন শুরু হয় কারখানাটিতে।
বিজ্ঞাপন
গ্যাস সংকট কাটতে যে আরও সময় লাগবে তা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী। গত ২৪ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের দেশেও গ্যাস সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতেও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটি সাময়িক সমস্যা, আগামী জানুয়ারি মাস থেকে এই সংকট কেটে যাবে।
গত নভেম্বরের শুরুতে ব্যবসায়ীরা বলেন, গ্যাস না থাকায় যে ফ্যাক্টরিতে দুই শিফট ছিল সেখানে এক শিফটে কাজ করাতে হচ্ছে। অর্ধেক কাজ করিয়েও শ্রমিকদের পুরো বেতন দিতে হচ্ছে। আবার উৎপাদন কম হওয়ায় লোকসান দিতে হচ্ছে। ডাইং ও ওয়াশিং প্লান্টগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকলেও লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নিট কারখানাগুলোতে একবার গ্যাস চলে গেলে পরবর্তীতে বয়লার হিট করতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। শুধু পোশাক শিল্পেই নয়, অন্যান্য কারখানাগুলোরও বেহাল অবস্থা। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিরামিক শিল্প।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও এক্সিলেন্ট সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল হাকিম সুমন তখন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের সিরামিক কারখানাগুলোর প্রধান উপকরণ গ্যাস। আমাদের কিছু মেশিন আছে যেগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। তা না হলে নষ্ট হয়ে যায়। চলমান এই গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের উৎপাদন কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। বারবার সরকারের সাথে আলোচনা করা হলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। এই ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন তখন বলেন, চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অপারেট খরচ বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। আবার গ্রাহকদের ঠিক মতো প্রোডাক্ট সরবরাহ না করতে পারায় তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেছিলেন, উৎপাদন একেবারে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। গাজীপুরে সকালে বিদ্যুৎ গেলে বিকাল ৫টায় আসছে। তাহলে শিল্প এলাকা থাকল কী করে? জরুরিভিত্তিতে ৫০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস কেনার চুক্তি করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখেন। আর স্বল্পমেয়াদে দ্রুত ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কিনতে বলেন। এ পরিমাণ জ্বালানির নিশ্চয়তা পেলে আগামী এক বছর শিল্পে সমস্যা থাকবে না। এতে যদি প্রতি ইউনিটে ৪-৫টাকা বেশি দরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কিনতে হয়, তাতেও ব্যবসায়ীরা রাজি বলে জানান তিনি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি স্বপ্না ভৌমিক বলেন, গত দুই মাসে ২৭টি কারখানা পরিদর্শন করেছি। তারা ভয়ে আছেন কখন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশবান্ধব অনেক মেশিনারিজ ব্যবহার করা যাচ্ছে না গ্যাস সংকটে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
গ্যাস সংকট নিয়ে গত ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর সাথে আলোচনায় বসেন ব্যবসায়ী নেতারা। সেখানেও ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, দিনের ১২ ঘণ্টাই শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে উৎপাদন অনেক কমে যাচ্ছে।
কিন্তু সেদিন তেমন কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এলএনজি আমদানি করার টাকা নেই। এখন ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, আমাদের ভোলায় কিছু গ্যাস আছে, সেগুলো সিএনজিতে করে নিয়ে আসব। সেখানে ৮০ এমএমসি গ্যাস আছে। আমরা দু-তিন মাসে সেটা নিয়ে আসার চেষ্টা করব। অপরদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পাব। আরও এক হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করব। তখন অনেকটাই সমস্যার সমাধান করতে পারব।
গ্যাস সংকট শিগগিরই নিরসনের আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। গত ২৬ নভেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আশা করছি শিগগিরই গ্যাস সংকট নিরসন হবে। বাংলাদেশ ব্রুনাই থেকে গ্যাস আমদানি করবে। ব্রুনাই থেকে গ্যাস আসা শুরু হলেই পোশাক কারখানায় জ্বালানির সমস্যা দূর হবে।
টিএই/এমআর