শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০২২ সাল। বছরের শুরুটা কেমন হয়েছিল আমার তেমন একটা মনে পড়ে না। শুধু এটুকু জানি, তখন আমি ভয়াবহ ডিপ্রেশনে ছিলাম, যার সূচনা ছিল ২০১৯ এর শেষদিকে। কী কারণ, কেন সেসব এখানে অবান্তর। আমার সমস্যা হলো, যেকোনো কিছু থেকে বের হতে লম্বা সময় লাগে। একবার বের হয়ে গেলে সেটা নিয়ে আর ভাবি না। যাই হোক, সেই ডিপ্রেশন অনেকটুকু কাটল ফেব্রুয়ারিতে এসে। বাকি যা ছিল তা আস্তে-ধীরে আমার কাউন্সিলর চৌধুরী নাজমুল পারভেজ সাহেবের তত্ত্বাবধানে থেকে কাটতে লাগল, যা এখনো চলমান প্রক্রিয়া। আমি উনার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
মানুষের জীবন বহতা নদীর মতো, কখনো শান্ত নিস্তরঙ্গ, কখনো তীব্র স্রোত সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমার জীবন খুবই সাদামাটা কেটেছে। আনন্দের খুব বেশি বাঁক দেখার সৌভাগ্য হয়নি প্রথম দুই জীবনে। দুটো সাদাকালো জীবন পার করে এখন যখন রঙিন জীবনে ঢুকে পড়লাম, নিজেকে আজকাল প্রজাপতির মতো মনে হয়।
বিজ্ঞাপন
২০২২ সালে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। ঘটলে আমিও খুশি হতাম, আনন্দটা বারবার মনে করে জাবর কাটতাম। তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপার গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি এ বছর। আমি যে সময়গুলোতে আমার আশপাশে কাউকে পাইনি তীব্র প্রয়োজনের সময়, কোনোরকম সাহায্য আসার একটা রাস্তাও দেখিনি, তখন প্রতিবার সৃষ্টিকর্তা এমন এমন সাহায্য আমার জন্য পাঠিয়েছেন, এমন এমন মানুষের দ্বারা, যা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের হার বেড়েছে- এটাই এ বছরের আমার উল্লেখযোগ্য বিষয়।
কোনোকালেই আমার অর্জন খুব বেশি ছিল না। ছোটখাটো যা কিছু তার সমন্বয় করলে একটা সুগন্ধি ফুলের মালার মতো হবে যা মিষ্টি মিষ্টি সুবাস ছড়াবে। এটুকুই, এর বেশি না। এ বছর আমার অর্জন, বইমেলা ২০২২-এ বাঁধন প্রকাশনী থেকে বের হওয়া প্রতিভাবান লেখক এবং কবিদের লেখা ও কবিতার সমন্বয়ে প্রকাশিত সংকলিত বই ‘শব্দ দহন-দ্বিতীয় স্রোত’ এ আমার দুটো লেখার স্থান পাওয়া।
বিজ্ঞাপন
মানুষমাত্রই মনে করে, ‘ইশ, ওই কাজটা ওরকম না করে সেরকম করলে হয়তো আজ ফলাফল এমন না হয়ে তেমন হতো’। খুবই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য মানুষের, কেউই তার ঊর্ধ্বে না। অবশ্য আমার তেমন কোনো আফসোস এ বছরে জমা হয়নি। একটা জিনিস আয়ত্ত করেছি দেরিতে হলেও- যা পাচ্ছি, যা খাচ্ছি, যা পরছি, শুকরিয়া। এতটুকুও তো একসময় পেতাম না, করতে পারতাম না। তাই সর্বক্ষেত্রে, আলহামদুলিল্লাহ। জীবনযাত্রা যেমন ছিল, তেমনই আছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে কেবল। আগে কিছু করতে না পারলে মন খারাপ হতো, এখন হয় না। মনে হয়, সঠিক সময়ে ঠিক এই জিনিসটাই আমার হাতে আসবে যেভাবেই হোক।
জীবন থেকে কাউকে হারানো ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কেউ পেয়েও হারায়, কেউ না পেয়েও পায়। পাশের মানুষটা মনে করে, ‘পাইলাম, ইহাকে পাইলাম’। অথচ এক ইঞ্চি দূরে বসে থাকা মানুষটা আদতে কোটি কোটি মাইল তফাতে। পাওয়া-হারানো চলতেই থাকে- বহমান প্রক্রিয়া। আসবে যাবে স্রোতের মতো, চিরস্থায়ী কিছুই নয়।
আমি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। কাউকে উপদেশ দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না, সেই যোগ্যতাও নেই। অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটা কথা বলতে পারি কেবল। মানুষ নিজের জন্য নিজে। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজের। কারো ওপর নির্ভর করা মানেই হলো আরেকজনের মর্জির শেকলে বন্দি হওয়া। অন্যজনের হাতের পুতুল হওয়ার মতো অসম্মানজনক আর কিছুই নাই, সে পরিবারের যে মানুষই হোক না কেন। শুনব সব, কিন্তু কাজ করব আমার নিজের মতো। নিজ সিদ্ধান্তে মরাও সুখের। শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ। মাথা নত কেবল উনার কাছে, আর কারো কাছে না। দেওয়ার মালিক উনি, নেওয়ার মালিকও উনি। এটুক মনে রাখলেই চলবে।
অর্থনৈতিক দিক ছাড়া চরিত্রগত এবং বৈশিষ্ট্যগত কোনোরূপ পরিবর্তন করার আমার কোনো ইচ্ছা কিংবা পরিকল্পনা নেই। যেমন আছি, তেমনই শুকরিয়া। এতে অবশ্য আমার আশেপাশের মানুষের বেশ ভালোই অসুবিধা হয়। তবু আমি বদলাতে চাই না। আমাকে যে ভালোবাসবে, আমার ভালো-মন্দ নিয়েই ভালোবাসবে। না পারলে সেই ভালোবাসা না বাসলেই ভালো।
নতুন বছরে কিছু পরিমার্জন করার নেই। যা আছে, যেমন আছে সেগুলোই শানিত করার প্রচেষ্টা থাকবে। দেশের ক্ষেত্রে চাই- ট্রাফিক জ্যাম কমুক, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হোক, বেতন কাঠামো ঠিক হোক, মানুষে মানুষে পরস্পর সহিষ্ণুতা বাড়ুক। কন্যা সন্তানের মা হিসেবে চাই- সর্বস্তরে আমার কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, এসবই। খুব সাধারণ ও মৌলিক জিনিসগুলোরই সমাধান হয় না, এর বেশি আমি আর কী চাইতে পারি।
যেভাবে যা যেমন চলছে, চলুক। আমরা পথিক, পথের শেষ আসুক, যাত্রাপথে যেমন দায়িত্ব আসবে তেমন পালন হোক, বাকিটা নিজের মনের আনন্দে ব্যয় হোক। আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
লেখক: রেজিস্ট্রার (নাক, কান, গলা বিভাগ), নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং স্বত্বাধিকারী ‘ডক্টরস কিচেন বাই বর্ণা’