রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে সামরিক যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের পর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা- বিশেষ করে ইমার্জেন্সি হেলথ রেসপন্স বা জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নটি আবারো সামনে এসেছে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে ওই দুর্ঘটনার পর আশেপাশের হাসপাতালগুলোই ছিল হতাহতদের চিকিৎসার প্রাথমিক গন্তব্য। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ায় যে সময় লেগেছে সেটি আহতদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে কি না এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া পোড়া রোগীর চিকিৎসায় সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা থাকলেও হাসপাতালে রোগীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সেলফি তোলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতেও কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের হাসপাতাল পরিদর্শন কিংবা হাসপাতালের বাইরে উৎসুক জনতার উপচেপড়া ভিড় নিয়ন্ত্রণও পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এই পুরো প্রেক্ষাপট জরুরি চিকিৎসা সেবা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক দুর্বলতাকে আবারো সামনে এনেছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, কেবল এই দুর্ঘটনা নয়, যেকোনো ইমার্জেন্সি রেসপন্স বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো বেসিক (প্রাথমিক) পর্যায়ে।

এমন জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের প্রস্তুতি বিশ্বমানের না হলেও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রয়েছে বলেই মনে করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। তার মতে, ‘চিকিৎসা খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যথেষ্ট মনোযোগ না পাওয়ায় এক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি।’
বিজ্ঞাপন
‘কথা বলতে বলতে আমার ভাইটা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে গেছে। হাসপাতালে গিয়াই রাত তিনডার দিকে মারা গেছে,’ বিবিসি বাংলাকে এভাবেই বলছিলেন মাইলস্টোল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়ানের ভাই আবু শাহিন।
গত ২২ জুলাই রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরিয়ানের। তার মতো এই দুর্ঘটনায় আহত অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। যাদের কেউ কেউ সঠিক চিকিৎসার জন্য একাধিক হাসপাতাল বদলাতেও বাধ্য হয়েছিলেন।
অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় এবং সক্ষম হাসপাতাল জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। বিশেষায়িত এই হাসপাতালে দুর্ঘটনার দিনের পরিস্থিতি ছিল বেশ জটিল।
হাসপাতালের বাইরে উৎসুক জনতা, স্বেচ্ছাসেবক, গণমাধ্যমকর্মীসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের ভিড় দেখা গিয়েছিল। যাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেও ওই দিন কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলেন। ঘটনার পরদিনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে হাসপাতালে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করে প্রশাসন।
সেদিন সরেজমিন কাজ করা গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকে বলছেন, দুর্ঘটনাস্থলের দূরত্ব, অতিরিক্ত মানুষের ভিড় এবং আশপাশের সড়কগুলোতে সৃষ্ট যানজটের কারণে রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অথচ এই ধরনের পরিস্থিতিতে 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স' খুবই জরুরি বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলছেন, মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনায় আহত অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। যাদের অনেকের পরিস্থিতি হাসপাতালে আসার আগেই খারাপ দিকে গিয়েছিল।
তিনি বলছেন, বার্নের রোগীর ক্ষেত্রে ফ্লুইড রিসাসিটেশনটা আপনি যদি উইদিন আওয়ার (ঘণ্টার মধ্যে) শুরু করতে পারেন তাহলে তার রেজাল্টটা অনেক ভালো হয়। তার সারভাইবল রেশিওটা (বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা) অনেক বেড়ে যায়।

পোড়া রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বিশ্বমানের না হলেও ভালো সক্ষমতা রয়েছে বলেও দাবি হাসপাতালটির পরিচালকের। তিনি বলছেন, ‘আমার বার্ন ইনস্টিটিউটের ইমার্জেন্সি হ্যান্ডেল করবার, আমি বলব না যে একেবারে বিশ্বমানের, তবে আন্তর্জাতিক মানের আমরা বলতে পারি।’
জরুরি চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশের সক্ষমতা
মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনার পর জরুরি চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে পুরনো প্রশ্ন আবারো সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যাগত উন্নতি হলেও দেশের জরুরি চিকিৎসা সেবার তেমন উন্নতি হয়নি। তারা বলছেন, এখনো নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালের ওপরই সবাইকে নির্ভর করতে হয়। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে সেবা সংস্থাগুলোর রেসপন্স এবং আহতদের চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও এখনো পুরোপুরি হাসপাতাল নির্ভর।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলছেন, ‘মাত্র দুই-চারটা বড় হাসপাতাল ছাড়া আমাদের ইমার্জেন্সি রেসপন্সটা মূলত চিকিৎসক, নার্স তারা যে আন্তরিকতাটুকু দেখায় সেটার ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল।’
জরুরি চিকিৎসা কেবল হাসপাতালকেন্দ্রিক নয় বরং যেখানে ঘটনা ঘটবে সেখানেই যদি এটা শুরু হয় তাহলে আরো অনেক মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো বলেও মনে করেন বেনজির আহমেদ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে সক্ষমতা দেখিয়েছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেই সফলতা তৈরি করতে পারেনি বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বেনজির আহমেদ বলছেন, ‘স্বাস্থ্য ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রে আমাদের রেসপন্সটা সংগঠিতভাবে হয় না বলেই মৃত্যুর সংখ্যাটা বেড়ে যায়।’
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাবও দেখছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার যতটুকু সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে, তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসায় করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষেত্রে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ব্যুরোর সঙ্গে মিলে কাজ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার। যেখানে সামরিক বাহিনী, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, রেড ক্রিসেন্ট এবং স্বাস্থ্য বিভাগ যুক্ত থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘বিমান বিধ্বস্তের এই ঘটনায় এটা তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাক্টিভেট (চালু) না করে পরে করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ডেমোলিশন ইউনিট এখানে আসছে ঠিকই কিন্তু হেলথকে এখানে যুক্ত করে নাই। হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করে করেছে।’

এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই দুষছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন, ‘আমাদের সব চিন্তা হলো হাসপাতালকেন্দ্রিক। কিন্তু হাসপাতাল তো বেসিক ইউনিট। এটা কো-অর্ডিনেশন করার জন্য তো মেকানিজম আছে।’
জরুরি স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে করোনার পর স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি নিয়ে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন তারা।
দেশে জরুরি চিকিৎসা সেবার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য দিনশেষে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালই অধিকাংশ মানুষের ভরসা। জেলা উপজেলায় চিকিৎসা সক্ষমতা আগের তুলনায় বাড়লেও তা এখনো বেশ দুর্বল বলেই মনে করেন বিষেজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলছেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে আসা পর্যন্ত দেশে জরুরি সেবা দেওয়ার সক্ষমতা দুর্বল। তবে ‘হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা বড় শহরগুলোতে বর্তমানে ভালো’ বলেই মনে করেন তিনি। সাধারণ ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই বলেই মনে করেন তিনি।
তিনি বলছেন, ‘শিক্ষাগতভাবে এই পার্টিকুলার ডিসিপ্লিনটাই গড়ে ওঠেনি।’ যার ফলে ইমার্জেন্সি রেসপন্সের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের জায়গা এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করেন তিনি। পরিস্থিতি বদলাতে সরকার ‘ইমার্জেন্সি হেলথ প্রফেশনাল’ তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিশেষ সহকারী বলেন, ‘আগামীতে স্বাস্থ্য শিক্ষায় এই বিষয়টিকে আমরা ইনক্লুড করছি। যাতে আমরা কয়েক বছর পরে ইমার্জেন্সি মেডিকেল বিশেষজ্ঞ ও নার্স পাবো।’ তবে, প্যারামেডিক, অ্যাম্বুলেন্স ও হেলিকপ্টারসহ বাকি সক্ষমতা তৈরিতে আরও সময় লাগবে বলেও জানান তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা
জেবি















































































































































