পোড়া গন্ধ এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। মাইলস্টোন কলেজের ওই ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে পোড়া গন্ধে আটকে যায় শ্বাস-প্রশ্বাস। বিমান বিস্ফোরণের পর রক্তমাখা খাতার পাতাগুলো এখন নিঃসঙ্গ, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্কুলব্যাগগুলো যেন ক্ষত-বিক্ষত আত্মার প্রতিচ্ছবি। পোড়া ক্লাস রুমের এক পাশের অক্ষত টেবিলে পড়ে থাকা একটি ছেঁড়া রুটি, আধখাওয়া টিফিনের বাটি, শিক্ষক রুমে ভাত-তরকারি খুলে রাখা থালায় ধুলো মাখানো— এমন দৃশ্য যেন হয়ে উঠেছে সমগ্র ঘটনার হৃদয়ভাঙা প্রতীক।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কেউ ক্লাস করছিলেন, কেউ টিফিন খাচ্ছিলেন, কেউ খাওয়ার জন্য নিচ্ছিলেন প্রস্তুতি, হঠাৎ করেই আকাশ কেঁপে উঠল। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর ভেঙে পড়ল বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। উত্তরার রেসিডেনশিয়াল এলাকার নির্ভরতার প্রতীক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি অংশ মুহূর্তেই পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। শিশুদের চিৎকার, বিস্ফোরণের বিকট শব্দ, পুড়ে যাওয়া বইয়ের গন্ধ আর মানুষে-মানুষে ধাক্কাধাক্কি, সব মিলে এক বিভীষিকাময় দুপুর।
বিজ্ঞাপন
ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর এই প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে এক ধরনের স্তব্ধতা বিরাজ করছে, যা কান্নার চেয়েও ভয়ংকর। ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে বের করে আনা ব্যাগের ভেতর পাওয়া গেছে লাঞ্চবক্স; তাতে রাখা ছিল ভাজি ও রুটি। খাওয়া হয়নি। কেউ হয়তো ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ঘণ্টা আর বাজেনি। ধ্বংসস্তূপের পাশে পড়ে থাকা সেই ছেঁড়া রুটির দিকে তাকালে বোঝা যায়, কীভাবে জীবন থেমে যেতে পারে মাঝপথে।
এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৩১ জনের। তাদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু। আরও ১৬৫ জন গুরুতর আহত হয়ে ভর্তি আছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা বলছেন, দগ্ধদের অনেকেই আশঙ্কাজনক। অনেক শিশুর শরীরের অর্ধেকের বেশি অংশ পুড়ে গেছে।
দুর্ঘটনার পরপরই ছুটে আসা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দগ্ধদের উদ্ধার করেন। সেনাবাহিনী ও আশপাশের বাসিন্দারাও বের করছিলেন পুড়ে যাওয়া দেহগুলো।
কেউ একজন বলছিলেন, মুখ দেখে চেনা যায় না। শুধু পায়ের জুতা দেখে শনাক্ত করতে হচ্ছে। এমনই ছোট্ট পায়ের অনেকগুলো জুতা এখনও পড়ে আছে ওই ধ্বংসস্তূপের পাশে। কোথাও এক জোড়া, কোথাও এক পা’র, আবার কোথাও শুধু মোজাটা আছে, জুতাটা মেলেনি।
দুর্ঘটনার পরপরই আহত শিশুদের চিৎকার শুনেছে জাতি। শুধু শিশুদের কান্না আর আর্তনাদ।
বিজ্ঞাপন
একদিকে সন্তানকে হারিয়ে মা-বাবার হাহাকার, অন্যদিকে স্মৃতির পাজরে আগুনের তান্ডব। ছেঁড়া খাতার পাতায় কেউ লিখে রেখেছিল- ‘ভবিষ্যতে আমি ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব।’ সেই ভবিষ্যতের পাতাটা পুড়ে গেছে। স্বপ্নের পৃষ্ঠাও ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে টিফিনের জন্য ব্যাগে নিয়ে যাওয়া বিস্কুটের প্যাকেট ও পানির বোতল।
একটি ছেঁড়া রুটিও হয়ে উঠেছে জাতির শোকের প্রতীক। সেই রুটি যার আধা খাওয়া অংশ দেখে বোঝা যায়, কেউ খেতে বসেছিল, কিন্তু আর শেষ করতে পারেননি। যে রুটি হয়তো একজন মা বানিয়েছিলেন ভালোবাসায়, শিশুর হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সন্তান খায়নি, রুটিটাই আজ একমাত্র সাক্ষী।
মাইলস্টোন কলেজ এখন পরিণত হয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভে। দেয়ালে লেখা- "Welcome To Classroom", "Work Hard", Believe in Yourself", "Try New".
জীবন কখনও কখনও এমন নির্মম হয়। ছেঁড়া রুটি, ছিন্ন ব্যাগ, পোড়া খাতা আর নিখোঁজ স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক জাতি— নীরব, অভিশপ্ত। এই অপূর্ণ আহার আর অপূর্ণ জীবন যেন প্রতিদিন নতুন করে খোঁচা দেয় আমাদের হৃদয়ে। আজ আর ওই শ্রেণিকক্ষে ঘণ্টা বাজেনি। শব্দ হয়নি কলমের।
দুর্ঘটনার সময় এই বিধ্বস্ত ভবনের দ্বিতীয়তলায় ছিলেন শিক্ষক সাইদুল আলম। তিনি বলেন, প্রথমে আমরা একটা শব্দ পাই। এরপর দেখি ডাব গাছে আগুন। ভাবি হয়তো বজ্রপাত হয়েছে। এরমধ্যেই বিরাট বিস্ফরণ। ধোঁয়ায় চারপাশ আঁধার। আমি লাথি মেরে গ্রিল ভাঙ্গি। সেসময় আমি ৭-৮ জনকে উদ্ধার করতে পেরেছি। আর সময়টা এমন ছিল, কেউ খাচ্ছিলো, তো কেউ খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
এমআই/এফএ















































































































































