শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত মায়ের দাফন সম্পন্ন, মূর্ছা যাচ্ছে তিন সন্তান

জেলা প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া 
প্রকাশিত: ২২ জুলাই ২০২৫, ০৩:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত মায়ের দাফন সম্পন্ন, মূর্ছা যাচ্ছে তিন সন্তান
এক মায়ের আত্মত্যাগ, এক পরিবারের চিরন্তন ক্ষতি। ছবি: ঢাকা মেইল

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত উম্মে হাবিবা রজনী ইসলামের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সাদিপুর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। সেই সঙ্গে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী হয় গোটা এলাকা—মায়ের লাশের পাশে কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল তার তিন সন্তান।

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) কাল ৯টায় সাদিপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ১০টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে ভোরে ঢাকার সামরিক হাসপাতাল থেকে রজনীর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। গ্রামের মানুষ ভিড় জমায় শেষবারের মতো রজনীকে দেখতে। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু—সবাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।


বিজ্ঞাপন


নিহত রজনীর স্বামী জহুরুল ইসলাম ঢাকায় ব্যবসা করেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে তিনি পরিবারসহ রাজধানীতে বসবাস করছেন। তাদের তিন সন্তান—বড় ছেলে রোবাই ইসলাম এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মাঝের ছেলে রোহান ইসলাম ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এবং ছোট মেয়ে ঝুমঝুম ইসলাম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

ঘটনার দিন রোহান অসুস্থ থাকায় স্কুলে যায়নি। মেয়ে ঝুমঝুম ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে ছিল। দুর্ঘটনার খবর শুনেই মা রজনী স্কুলের দিকে ছুটে যান সন্তানদের নিরাপদে আনতে। তখনই ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঝুমঝুম বলে, ‘আম্মু আমাকে নিতে আসছিল। আগুন আর ধোঁয়ায় আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। আমার আম্মু আর ফেরেনি…’

পরিবারের সদস্যরা জানান, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর রজনীর মাথায় আঘাত লাগে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে সিএমএইচে নেওয়া হয়, কিন্তু তিনি বাঁচেননি। তার শরীরে পুড়ার চিহ্ন না থাকলেও মাথার পেছনে আঘাত গুরুতর ছিল।


বিজ্ঞাপন


রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকার সামরিক হাসপাতাল থেকে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এরপর রাত দশটার দিকে পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ভোরে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বাওট গ্রামে রজনীর বাবার বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য মরদেহ রাখা হয়। সেখান থেকে সকাল ছয়টার দিকে মরদেহ পৌঁছায় দৌলতপুরের সাদিপুর গ্রামে।

স্বজনদের আহাজারি, প্রতিবেশীদের চোখের জল, আর তিন সন্তানের অশ্রুসিক্ত মুখ—সব মিলে এক বেদনাবিধুর পরিবেশ তৈরি হয় সাদিপুরে। সন্তানদের কেউ কেউ বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। বারবার ডাকছিল ‘আম্মু’, কিন্তু আম্মু আর সাড়া দিচ্ছিল না।

রজনীর স্বামী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তখন চট্টগ্রামে ছিলাম। খবর শুনেই ঢাকায় উড়ে আসি। মেয়েকে আমরা পেয়ে যাই, কিন্তু রজনীর খোঁজ মিলছিল না। পরে সামরিক হাসপাতালে গিয়ে দূর থেকে তার শাড়ি দেখে চিনে ফেলি। তখন বুঝলাম, সে আর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাথার পেছনে আঘাত ছিল, সম্ভবত বিমানের কোনো অংশ তাকে আঘাত করেছিল। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু না মেনেও উপায় নেই।’

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল হাই সিদ্দিকী জানান, ‘সকাল দশটার দিকে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। পরিবারকে সমবেদনা জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হচ্ছে। একটি পরিবারে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কখনো পূরণ হবার নয়। বিশেষ করে সন্তানের কাছে মা চির অপূরণীয়।’

রজনীর মৃত্যুতে শুধু একটি পরিবার নয়, শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা গ্রাম। যে মায়ের জীবন সন্তানকে ঘিরে ছিল, সেই মা-ই আজ নেই—এই বাস্তবতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেউ।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর