ভবনটিতে এখন কেবল ভাঙা ইট, ধুলোর স্তূপ আর একরাশ নীরবতা। অথচ এই ভবনের দেয়ালেই ছিল শিশুকণ্ঠের কোলাহল, টিফিন পিরিয়ডের ছুটোছুটি আর স্বপ্নের আঁচড়। এক সময়কার প্রাণবন্ত শ্রেণিকক্ষের ধ্বংসস্তূপে এখন পড়ে আছে পোড়া ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল-বই-খাতা-কলম-পেন্সিলের সঙ্গে কিছু পোড়া চিঠি'র স্মৃতি।
হ্যাঁ, একটা চিঠি—যেটা এখন এক টুকরো শৈশবের দলিল হয়ে ভিড় জমিয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও দর্শনার্থীদের চোখে। চিঠির ভাষা শিশুসুলভ, কিন্তু তার আবেদন এত গভীর, যে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কাঁদছেন, কেউ চুপচাপ তাকিয়ে আছেন অপলক, আবার কেউ মোবাইল ফোনে সেই চিঠি তুলে রাখছেন যেন ভোলা না যায়।
বিজ্ঞাপন
চিঠির লেখক মারিয়াম রেজা মাধুর্য। তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী। বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু তার ভাষার বিনয়, অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছুটি চাওয়ার আবেদন—সব মিলিয়ে যেন এক অনুপম শৈশবের নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
‘সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি আপনার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির একজন ছাত্রী। আমি অসুস্থতার জন্য ১৩.০৫.২০২৫ থেকে ১৫.০৫.২০২৫ পর্যন্ত স্কুলে আসতে পারিনি। অতএব, বিনীত প্রার্থনা এই যে, আমাকে উক্ত তিন দিনের ছুটি দিয়ে বাধিত করবেন।’
এই নিরীহ পঙক্তিগুলো পাঠ করে অনেকেই চোখ মুছেছেন। কেউ বলছেন, ‘আমার মেয়েরও তো এমন চিঠি ছিল ব্যাগে’, কেউ বলছেন, ‘এই বয়সেই কত বিনয়, কত সচেতনতা!’ আর কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন, ভাঙা চেয়ারটার দিকে, যেন সেখানেই এখনো বসে আছে মারিয়াম—চিঠিটা লিখে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

বিজ্ঞাপন
মারিয়ামের চিঠির পাশে পড়ে ছিল আরও কয়েকটি আবেদনপত্র। সবই একই ধরনের—জ্বর, দাঁতের ব্যথা, পারিবারিক সমস্যা কিংবা কোনো একদিন অনুপস্থিত থাকার ব্যাখ্যা।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রোহানুজ্জামান লিখেছে, ‘হঠাৎ আমার জ্বর দাঁতে ব্যাথা হয় বলেই গত ১৮-০৫-২০২৫ তারিখ হতে ২০-০৫-২০২৫ তারিখ পর্যন্ত স্কুলে আসতে পারিনি।’
তার শেষ বাক্যটা যেন এক হৃদয়গ্রাহী সম্মানজ্ঞাপন:
‘নিবেদক, আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র’।
আবার আরেকটি ছুটির আবেদন, ছাত্র নূর হাসানের—
‘পারিবারিক সমস্যার কারণে গত ২৪/০৫/২৫ তারিখ আমি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারিনি।’
সব চিঠিতেই আছে একরাশ বিনয়, বিনীত শব্দচয়ন আর শিশুদের দায়িত্ববোধের এক গভীর প্রতিচ্ছবি। যেন শিক্ষার পাঠ শুধু বইয়ের পাতায় নয়—মনে, মননে গাঁথা।
চিঠি ছিল আরও। তবে তা পুড়ে হয়েছে ছাই।
তিন পাতার নিচে অজস্র আবেগ জমে থাকে, কিন্তু এই শিশুদের হাতে লেখা আবেদনগুলো যেন কোনো লালকালি ছুঁয়েও বদলাতে পারে না তাদের সরলতা।
বিধ্বস্ত ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে এক অভিভাবক আয়েশা খাতুন বললেন, ‘বাচ্চাদের হাতে লেখা এই চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে মনে হলো, ওদের চোখে কতটা বড় স্কুলটা, কতটা বড় শিক্ষক, আর কতটা গুরুতর এই ছুটির অনুমতির আবেদন। অথচ সেই চোখদুটো আর কখনো এ ভবনে ফিরবে না হয়তো।’

চোখ মুছতে মুছতে এক গৃহবধূ বললেন, ‘আমার ছেলেটাও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তবে অন্য স্কুলে। দেখতে এসেছিলাম। এখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না।’
এই ছুটির চিঠিগুলো এখন আর কেবল অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা নয়। এগুলো এক একটি নিখুঁতভাবে লেখা শৈশবের প্রতিকৃতি। যেখানে অক্ষরগুলোর ভেতরে বাস করে স্বপ্ন, কাগজের প্রতিটা লাইনে লুকিয়ে থাকে নিষ্পাপ শ্রদ্ধা, আর প্রতিটি স্যারের নামে শেষ হওয়া বাক্যে প্রতিফলিত হয় বিশ্বাস।
শুধু ছুটি চায়নি তারা—চেয়েছিল অনুমতি, সম্মান, একটি স্পর্শ। আর আজ, সেই আবেদনপত্রগুলো পড়ে স্কুলের ধ্বংসস্তূপে ছুটে আসে এক অন্যরকম বৃষ্টি। অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে অভিভাবকদের চোখ থেকে।
বললে ভুল হবে না, ভবনটি ধসে পড়েছে—কিন্তু ছুটির আবেদনগুলোর মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু অপরাজেয় শিশু। যারা হয়তো এখন আর স্কুলে আসে না, কিন্তু তাদের বিনয়ের ভাষা ছুঁয়ে দিচ্ছে হাজারো হৃদয়।
এমআই/জেবি















































































































































