শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ডাকসু-জাকসুতে কোথাও নেই ছাত্রদল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ডাকসু-জাকসুতে কোথাও নেই ছাত্রদল
ডাকসু-জাকসুতে কোথাও নেই ছাত্রদল

নানা অভিযোগ আর নাটকীয়তার মধ্যে শেষ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। দুইটি সংসদের মোট ৫৩টি পদেই পরাজিত হয়েছে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল। কোথাও কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, চলতি মাসের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন এবং ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু নির্বাচন। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেয়ে বড় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল। ডাকসুর ২৩টি ও জাকসুর ২০টি পদে বিজয়ী হয়েছে তারা। ডাকসুর বাকি পাঁচটি পদের মধ্যে চারটিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং একটি পদে জয় পেয়েছেন বামপন্থী প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’-এর একজন প্রার্থী। 


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে, জাকসুর বাকি পাঁচটি পদের মধ্যে একটি (ভিপি পদ) গেছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের হাতে, দুটি পদ পেয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), আর দুটি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এছাড়া জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই আন্দোলনের কয়েকজন নেতাও অংশ নিয়েছিলেন ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে। কিন্তু তারা ভোটে জিততে পারেননি। একইভাবে বড় ধরনের ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদলেরও।

তথ্য অনুযায়ী, ডাকসুর ভিপি পদে জয় পেয়েছেন শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের মো. আবু সাদিক ওরফে সাদিক কায়েম। তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রদল সমর্থিত আবিদুল ইসলাম খান, যিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। জিএস পদেও জয়ী হয়েছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থী এস এম ফরহাদ। তিনি পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানবীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। এজিএস পদে শিবিরের মো. মহিউদ্দিন খান বিজয়ী হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট।

আরও পড়ুন

ডাকসু ও জাকসুতে বিপর্যয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি?

যদিও এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা ও ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তিনি দাবি করেছেন, নির্বাচন ছিল নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। এটি ছিল একটি মডেল নির্বাচন।


বিজ্ঞাপন


সামাজিকমাধ্যমে উমামা ফাতেমা লিখেন, ‘ডাকসু বর্জন করলাম। সম্পূর্ণ নির্লজ্জ কারচুপির নির্বাচন। পাঁচই আগস্টের পরে জাতিকে লজ্জা উপহার দিল ঢাবি প্রশাসন।’ একই সঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘শিবির পালিত প্রশাসন’ বলেও মন্তব্য করেন।

আবিদুল ইসলাম খান বলেন, পরিকল্পিত কারচুপির এই ফলাফল দুপুরের পরই বুঝে গিয়েছিলাম। এখন নিজেদের মতো করে সংখ্যা বসিয়ে দিন। এই সাজানো নির্বাচনের ফল আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।

যদিও ছাত্রদলের ভিপিপ্রার্থীর সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর ছিল জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিমের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রায়কে সম্মান জানিয়ে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে তিনি লিখেন, যদি শিক্ষার্থীরা এটিকে তাদের রায় মনে করেন, তাহলে আমি সেটাই সম্মান করি।

অন্যদিকে জাকসুতে ভিপি পদে জয় পেয়েছেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ থেকে আব্দুর রশিদ জিতু। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট। জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের মাজহারুল ইসলাম, যিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৩০ ভোট। পুরুষ এজিএস হিসেবে জায়গা পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফেরদৌস আল হাসান ২ হাজার ৩৫৮ ভোটে এবং এজিএস (নারী) পদে দর্শন বিভাগের আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা ৩ হাজার ৪০২ ভোটে। তারা দুজনও শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে জয়ী হয়েছেন। 

নানা অভিযোগ তুলে ১১ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থীরা। যদিও তারা ভোট বর্জন করেছিল, তবুও কিছু ভোট পেয়েছে প্যানেলের প্রার্থীরা। পরে ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, ছাত্রদল প্যানেলের কেউ কোনো পদে জয়ী হয়নি। ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী শেখ সাদী পেয়েছেন ৬৪৮ ভোট। জিএস পদে একই প্যানেলের তানজিলা হোসাইন বৈশাখী পেয়েছেন ৯৪১ ভোট।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত ও শিবিরের সঙ্গে যোগসাজশ করে নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং করার অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল সমর্থিত সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী। তিনি বলেন, আমরা ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচন দাবি করেছি। কিন্তু ভোটকেন্দ্র মনিটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জামায়াত নেতার কোম্পানিকে, যা ভয়াবহ।

আরও পড়ুন

‘নির্যাতন-দমন’ পেরিয়েও শিবিরের জাকসু জয়

তানজিলা হোসাইন বৈশাখী আরও বলেন, জামায়াত নেতার কোম্পানিই ওএমআর মেশিন সরবরাহ করেছে। এতে শিবিরের প্যানেলকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।’

অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার অভিযোগ করেন শিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ওএমআর মেশিন যে প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়েছে, তার রাজনৈতিক পরিচয় বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতার।

এরপর নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্প্রীতির ঐক্য, সংশপ্তক পর্ষদসহ চারটি প্যানেল পর্যায়ক্রমে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। বিগত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও দলীয় প্রভাবের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম খান জাকসু নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তিন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ সময় ধারাবাহিক ঘটনার কারণে নির্বাচন বাতিলের শঙ্কা তৈরি হয়। তবে বাকি প্যানেলের প্রার্থীরা ফল প্রকাশের দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান নেন।

ওএমআর মেশিনে ফলাফল গণনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সোহাগী সামিয়া ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনার দাবি করেন। এরপর জরুরি বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

জাকসু নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ কারচুপি বা জাল ভোট প্রমাণ করে, আমি পদত্যাগ করব এবং আমার পেনশনের টাকা নেব না। যারা ভোট বর্জন করেছেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। ভোট বর্জন বা গ্রহণ করা সবাইয়ের গণতান্ত্রিক অধিকার।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতারা মনে করেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনায় শিবির নেতৃত্ব বেশি ছিল। এই কারণেই ডাকসু নির্বাচনে তাদের বড় জয় হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, গত এক বছরে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব নিয়ে গড়া ন্যারেটিভ ভোটারদের প্রভাবিত করেছে।

আরও পড়ুন

ঢাবির সিনেট সদস্য হচ্ছেন ডাকসুর যে ৫ জন

অধ্যাপক নাসরীন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা নিয়ে যে বিতর্ক ছিল, সেখানে শিবির বলেছে, মূল পরিকল্পনা ও আন্দোলনের সব নেতৃত্ব তাদের। যেমন—প্রোফাইল লাল করা, এক দফার দাবি, স্লোগান সবকিছুর মূল তারা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তখন তারা নিজের পরিচয় সামনে আনেনি।

ডাকসুর সাবেক ছাত্র নেতা মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে যে ধরনের রাজনীতি চলে আসছে, তা বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ হারিয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি ও সুযোগকে তরুণ প্রজন্ম গুরুত্ব দিয়েছে, বলেই তারা সেই দলগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকেছে বলে তিনি মনে করেন।

১৯৮৯-৯০ সালে মুশতাক হোসেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় ছাত্রশিবিরও নির্বাচনে অংশ নেয়। তিনি মনে করেন, এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হয়ত শিবিরকে একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছে।

মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানে র‌্যাডিকাল ইসলামিস্ট শক্তি যে ভূমিকা নিয়েছে, তা না হলে শেখ হাসিনার শক্তিশালী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হতো না। এটা হয়ত সমর্থনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে।’

তিনি আরও বলেন, যদি শিবির ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী পথে যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ দ্রুত গড়ে উঠবে। তবে এই দলের রাজনৈতিক আদর্শ লিবারেল ডেমোক্রেটিক ধারার রাজনীতির সঙ্গে যায় কি না, সেটাও প্রশ্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, গণ অভ্যুত্থানের পর অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় ওই হারের কারণ হয়েছে। তরুণ ভোটাররা এসব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোর বেশিরভাগ ভোট পড়েছে ছাত্রশিবিরের পক্ষে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, গত এক বছরে পাঁচই অগাস্টের পর কার দল সরকারের ওপর বেশি প্রভাবশালী এবং দেশ কারা চালাচ্ছে—এমন বিষয় ডাকসু ও হল সংসদের ভোটাররা গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন।

অধ্যাপক নাসরীন বলেন, ‘ভোটাররা দেখেছেন, কে সরকারের ওপর অদৃশ্য প্রভাব রাখছে বা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ভাবছেন, কে ক্ষমতায় আসতে পারবে এবং কেউ ভোট নষ্ট করতে চায় না।’

এসএইচ/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর