হেডিংটার মতো লেখাটাও প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই। আর সেটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এত শিক্ষার্থী ছাত্রশিবির করে বা সমর্থন করে? ক্যাম্পাসে সাড়ে ৮ বছরের রিপোর্টিং অভিজ্ঞতা থেকে বলব- না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে: ছাত্রশিবিরের প্যানেল ভূমিধস বিজয় নিয়ে সারাদেশে কীভাবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল? কী করে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করল?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, বিএনপির ভারতপন্থী রাজনীতি বা আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠা এবং জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির বিরুদ্ধে অবস্থানই সাধারণ ভোটারদের বিকল্প খুঁজে নিতে বাধ্য করেছে। কেননা, এ দেশের মানুষ জাতীয়তাবাদী এবং ভারতবিরোধী রাজনীতি চায়। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগ হতে চায়, তাহলে যে শূন্যস্থান তৈরি হবে- সেটা যারা পূরণ করবে, মানুষ তাদেরই গ্রহণ করবে। ডাকসুতে হয়েছে সেটাই।
বিজ্ঞাপন
গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম বিশেষ করে বিএনপির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটা ‘দ্রোহ’ হচ্ছে ডাকসুতে এই জনরায়। ছাত্র-ছাত্রীরা এই রায় দিয়ে বুঝাতে চেয়েছে যে, তারা রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার, ফ্যাসিস্ট বিতরণ আর দেশ মুক্ত করেছে একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখার জন্য। দেশটা জনগণের, রাজনৈতিক দলের নয়; সংবিধান, আইন, ঘোষণাপত্র ইত্যাদি করতে হবে জনগণের জন্য। নিজের দেওয়া দফাগুলোর ওয়াদা রক্ষা করতে হবে; বিভক্তির রাজনীতি এই যুগে আর চলবে না। দেশকে ভারতীয় বয়ানে চালানো যাবে না। স্বদেশী হতে হবে, হতে হবে জনবান্ধব। ইতিবাচক রাজনীতি নিয়ে আসো, তোমার কর্মসূচি দাও- আমার যারটা ভালো লাগবে, তাকে আমার সেবক বানাবো।
এই রায় এসব কথাই বলছে! দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন রাজনীতিবিদরা। এই বিষয়ে তারা বিশেষজ্ঞ। রাজনৈতিক দলই একটা দেশের শাসনব্যবস্থার প্রাণশক্তি। তাই কেবল বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ, বাম সংগঠন, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ ইসলামিক পার্টি সবই আমাদের দেশের সম্পদ। এটা বহুত্ববাদী সমাজ আমরা দেখতে চাই। বহুদলীয় মিথষ্ক্রিয়ায় গাণিতিক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে যে এন্টিথিসিস বা বিরোধাভাস তৈরি হবে সেটা নিয়ে আসবে গ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি। এই প্রক্রিয়ায় সমাজ এগিয়ে যাবে। যদিও শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন বাপের মতোই একদলীয় রাষ্ট্র গড়বেন। কায়েম করলেন ডিজিটাল বাকশাল বা বাকশাল-২। তিনি চেয়েছিলেন আজীবন ক্ষমতা ভোগ করবেন। তার মৃত্যুর পর পার্টির (আওয়ামী লীগ) কী দশা হবে বা লাখ লাখ নেতাকর্মীর ভাগ্যে কী পরিণতি হবে, তা তার ভাবার দরকার নেই।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার খেলা ছিল ভিন্ন। তাকে জীবিত রেখেই তার পার্টির ‘অকাল মৃত্যু’ দেখালেন আল্লাহ। তাই জাতীয় স্বার্থেই আমরা চাই বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক পার্টি প্রোপারলি ফাংশন করুক। কেননা, রাজনীতি তো রাজনীতিবিদরাই করবেন। যদিও আমরা দেখছি, ফ্যাসিস্টের প্রত্যক্ষ সহযোগী জাতীয় পার্টির আস্ফালন। আবার এই পার্টির পক্ষ নিয়েছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, সেকেন্ড আওয়ামী লীগ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে তারা।
বিএনপির আস্কারায় ও সুযোগ পেয়ে বামদের সব ‘সফট পাওয়ার’ সক্রিয় এখন। গুপ্ত আওয়ামী লীগ, বাম, জাতীয় পার্টি সব ভর করেছে এই বিএনপির ওপর। তারা ভারতীয় প্রেসক্রিপশন এমনভাবে গিলেছে যে, আওয়ামী লীগের স্লোগান রপ্তই কেবল করেনি, একই ভাষায় ব্যবহার করছে। মেঘমল্লারা যেই স্লোগান দেয়, সেটা তারা ধার করে।
বিজ্ঞাপন
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এমন অবস্থানে যদিও বিভিন্ন পর্যায়ের দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত, ক্ষুব্ধ, মূক। কেবল সোচ্চার তিন শ্রেণির লোক। এক. পার্টির পদ-পদবি ব্যবহার করে আগামীতে হালুয়া-রুটিতে ভাগ বসানোর অসৎ আয়োজনে লিপ্ত; দুই. যারা ইতোমধ্যে চাঁদাবাজি ও ধান্ধাবাজি করে কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পদপদবি বাগিয়ে নিয়েছে; তিন. আওয়ামী লীগকে শেল্টারের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জনকারীরা।
যেই জামায়াতে ইসলামির সহায়তা নিয়ে ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেছে, ১৯৯৭ সাল থেকে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করেছে, তাদেরকে এখন ভারত ও আওয়ামী লীগের ‘বয়ানে’ আক্রমণ করছে। অথচ ওই বয়ান ১৬ বছর এ দেশের মানুষকে শোষণ, দেশের সম্পদ লুট ও পাচারে ব্যবহার এবং দেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন থেকে বিএনপি শিক্ষা নেয়নি। তারা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, ১৬ বছর ধরে যেই ট্যাবলেট ফেরি করার পরও জেন-জি ও জেন-আলফা বমি করে ফেলে দিয়েছে এবং ফেরিওয়ালাদের দিল্লি পাঠিয়ে দিয়েছে, সেই ট্যাবলেট আর এ দেশে চলবে না।
বহু আগেই বদলে গেছে ভোটের জিওগ্রাফি। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ আর নিজেদের ৩৫ বছর আগের ভোটের হিসাব নিয়ে পড়ে আছে! ভাবছে, ৩০ ও ৩৫ আর পায় কে? তরুণরা বা নতুন ভোটাররা যে এখন ফ্যাক্টর সেই হিসাব মাথায় ঢুকছে না বিএনপির। যাদের মাথায় ঢুকেছে তারা ঠিকই জয় ছিনিয়ে এনেছে ডাকসুতে।
অথচ এই বিএনপি নামক দলটিকে সরকারে পাঠানোর জন্য এ দেশের মানুষের কিন্তু প্রস্তুতি ছিল, আছে!
আমি মনে করি, এই ডাকসু নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রটা জনগণের। জনগণ জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা বুঝে নিয়েছে। চাবিকাঠি এখনও তাদেরই হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জুলাইয়ের মতই যেন সতর্কবার্তা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে।
আমার একটা লেখায় বলেছি, বিএনপি যে পথে হাঁটা শুরু করেছে, তাতে তাদেরকে আওয়ামী লীগের ভাগ্যই বরণ করা লাগতে পারে। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিকে আমার একটা লেখা সম্প্রতি প্রধান শিরোনাম হয়েছে, যেখানে আমি বলেছি- শেখ মুজিবের ভাগ্য বরণের দিকে যাচ্ছেন তারেক রহমান। আরেক লেখায় বলেছি, নানান ম্যাকানিজমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও ২-৩ বছরের মধ্যে আরেকটা গণ-আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হবে।
আমি আজও বলছি, এই ডাকসু নির্বাচন থেকে শিক্ষা না নিলে তারা হয়তো ক্ষমতার সিঁড়িই খুঁজে পাবে না। আর ভারত, আওয়ামী লীগ এবং সেনাবাহিনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ওপর ভর করে সরকার যদি গঠন করতেও পারে, ২-৩ বছরের মধ্যে ফের গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে হবে, যেটা হতে পারে তাদের সমাধি রচনা।
কেননা, আমরা জানি, ফরাসি বিপ্লব পরিণতি হতে কত বছর লেগেছিল। আমাদের এই আইকনিক বিপ্লবেরও হয়তো পরিণতি লাভ করতে আরেকটা বিপ্লব লাগবে, আর সেটি হবে আওয়ামী লীগের মতই বিএনপির অপমৃত্যুর মাধ্যমে- যদি না নীতি-নির্ধারকরা এখনও সজাগ না হোন।
তাদের বোঝা উচিত, আমাদের জুলাই বিপ্লব এখন বিশ্বে মডেল। নেপালের বিপ্লব ছিল বাংলাদেশেরই কপি। ভারতেও এমন বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছে। দেশে দেশে আরও অনুসৃত হবে। এ নিয়ে অনেক একাডেমিক গবেষণা হচ্ছে। এটা এখন ক্লাসিক্যাল উদাহরণ।
পরিশেষে বলব, আমরা এমন রাজনৈতিক দল চাই যারা জনগণের রায়ের প্রতি আস্থা রাখবে; এদেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। ভোটের বৈতরণি পার হতে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা করবে, ভারত বা আওয়ামী লীগকে নয়। জনগণের রায় নিয়ে সংবিধান স্বীকৃত সময়ের জন্য দেশের জনগণের সেবকের আসনে বসবেন তারা। যে কর্মসূচি দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসবেন, সেগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করে আবার জনগণের কাতারে চলে যাবেন- এমন সদিচ্ছা থাকবে। এরপর জনগণ ফের ভোট দিলে সরকারে আসবে।
এমন বিএনপি চাই না যারা ২০০৬ সালের মত কৌশল করে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়াবে, আর তার হাত ধরে এ দেশে ওয়ান-ইলেভেন ঘটবে এবং দেশ পিছিয়ে যাবে ২০ বছরের জন্য।
আরও প্রত্যাশা থাকবে, গত একটা বছর কেবল সংস্কার ইস্যুতে যে আচরণ করা হয়েছে, সেখান থেকে সরে আসবে বিএনপি। তারা দেশের মালিক নয়, সেবক- এটা মনে রাখবে। আমরা দেখেছি, ৩১ দফায় দেওয়া কোনো কোনো ওয়াদাও তারা মানতে নারাজ। একজন মাত্র ব্যক্তির বিষয়টা মাথায় রেখে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখতে তারা মরিয়া আচরণ করে, যেটা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। তাদের কারণে ফ্যাসিবাদের অনেক খুঁটি স্পর্শ পর্যন্ত করা যায়নি। যে কারণে ফ্যাসিবাদ এখনও উঁকি মারার সাহস পাচ্ছে। জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টার অভিযোগ মুক্ত হতে হবে বিএনপিকে। মাঠ-ঘাট, বাজার-হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা, টেলিভিশন-পত্রিকা ইত্যাদি দখলের কথা বাদই রাখলাম।
দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সহাবস্থান জরুরি। পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সরব উপস্থিতিও খুব প্রয়োজন। আরও জরুরি জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ, ১৪ দলের দস্যুদের সম্পদের হিসাব নিয়ে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। জাতীয় স্বার্থে এটা করতেই হবে। তারাই ১৬ বছর ধরে চলা গুম-খুন-লুটপাট-সম্পদ পাচারকে বৈধতা দিতে ‘বয়ান’ তৈরিতে বেশি কাজ করেছে। আর জাতীয় পার্টি নির্বাচন বৈধতা দিতে নির্লজ্জ ভূমিকা রেখেছে।
‘আমার বিরুদ্ধে যাতে ভবিষ্যতে আন্দোলন না হয়, তাই আত্মত্যাগীদের স্বীকৃতি দেবো না, খুনের বিচারও করব না’- এই থিওরিতে যে রাজনৈতিক দল থাকবে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে তাদের অপমৃত্যু অনিবারর্য। বিএনপি নেতৃত্বের সুমতি হোক, এই প্রত্যাশায়।
লেখক: সাবেক ডেপুটি চিফ রিপোর্টার, যুগান্তর ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি






















































































































