বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

স্বাধীনতার মূর্তপ্রতীক ম্যাডাম জিয়ার জানাজা ও কিছু কথা

মেশকাত সাদিক
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

স্বাধীনতার মূর্তপ্রতীক ম্যাডাম জিয়ার জানাজা ও কিছু কথা

আজ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ। শোকস্তব্ধ গোটা জাতি। বেগম জিয়ার আজ শেষ বিদায়। আর কোনোদিন তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে কিংবা গণতন্ত্রের পথে আপসহীনতা দেখাতে মিছিলের সামনে আসবেন না। তবে তিনি অমর। অন্তত আজকের জানাজা তার বিপুল উদাহরণ। পুরো বাংলাদেশটাই যেন আজ নেমে এসেছে জানাজায়। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে- এটি ছিল পূর্ব ঘোষণা। রাষ্ট্রযন্ত্র মনে করেছিল, এতে হয়তো যথেষ্ট হতে পারে। কারণ বিগত কয়েক দিনের ভয়াবহ শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন বস্তুত স্থবির। আজও ব্যাপক শীতের মারাত্মক প্রকোপ। সুতরাং মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আর ঢাকার বাইরে থেকে নেতাকর্মীর উপস্থিতি যথেষ্ট হবে না। কোনো কোনো গণমাধ্যম তো লাখো জনতার ঢল লিখে ও প্রচার করে ভাবছে এটাই বিরাট ইতিহাস।

কিন্তু জানাজার মাঠে সরাসরি উপস্থিত হতে গিয়ে বুঝলাম ম্যাডামের জানাজায় ৫০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটেছে। এর একটি বস্তুনিষ্ঠ হিসাব বলি। বেলা বারোটার পর থেকে গাবতলী হয়ে আসাদ গেটের রাস্তায় অটোমেটিক যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বসিলা হয়ে আসাদ গেটের রাস্তার একই অবস্থা হয়। নিউমার্কেট থেকে আসাদগেট, মিরপুর থেকে আগারগাঁও, জাহাঙ্গীর গেট হতে বিজয় সরনি হয়ে লেক রোড, ফার্মগেট-খামারবাড়ি হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, পুরো এলাকা মূলত জনতার ঢলে প্লাবিত। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।


বিজ্ঞাপন


মানুষের চোখে মুখে প্রচণ্ড ভালোবাসা আর আবেগের প্রগাঢ় ছাপ। অনেককে বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করতে দেখা গেল। কেউ কেউ বলছে-ভারতের সাথে সামান্য আঁতাত করলে ওনাকে জেলে যেতে হতো না। আবার একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, শোনেন! আমি আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজাতেও অংশগ্রহণ করেছিলাম। মানুষের যে আবেগ ছিল, আজও তাই লক্ষ্য করলাম। তবে শহীদ জিয়ার জাজাযার থেকে আজ বহুগুণ বেশি মানুষ। কারণ তখন দেশে তো এত মানুষ ছিল না। আজকের মতো ১৮/২০ কোটি মানুষ থাকলে তাঁর জানাজাতেও এমন মানুষ আসত।

বাংলাদেশ আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বিদায় দিতে অশ্রুভারাতুর। এই মাটি মানুষের প্রতি তাঁর যে প্রেম তাঁর কিছুটা ঋণ শোধ করছে আজ মানুষ। এই পবিত্র মাটি তাকে বুকে বরণ করতে প্রস্তুত। সত্যিই আজ বাংলাদেশ নীরব। এই নীরবতা কোনো সাধারণ নীরবতা নয়। এটি শোকের, ভারের, ইতিহাসের। রাজপথে মানুষের ভিড়। সর্বস্তরের লোকে লোকারণ্য। বাংলার আকাশে কালো পতাকা অর্ধনমিত। জনতার চোখে অশ্রু। কাঁদছে মানুষ। আকাশ বাতাস। বৃক্ষ তরুলতা। সব মিলিয়ে জাতি আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির সব বিতর্ক, মতভেদ, উত্তাপ এক পাশে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশ আজ অনিন্দ্য আপসহীন নেত্রীর বিদায়ে শোকস্তব্ধ। বেদনা-বিধুর পরিবেশ চতুর্দিকে ধীর লয়ে বহমান।

jj

কিছু মানুষ থাকেন, যাদের মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত নয়, তা রাষ্ট্রের স্মৃতিতে, দেশের ইতিহাসে, স্বাধীনতা-পতাকায় দাগ কেটে যায়। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই একজন। তিনি ছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা অবিসংবাদিত দেশপ্রেমিক নারী। শত ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ক্ষমতার বাইরে সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গতার প্রতীকও। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বিশ্ব-রাজনীতির পাঠ্যবইয়ে নিঃসন্দেহে স্থান পাওয়ার মতো। তাঁর সংগ্রাম, উত্থান, দ্বন্দ্ব, অবরুদ্ধতা এবং শেষ পর্যন্ত নীরব বিদায় রাজনীতিবিদদের জন্য একটি পরম শিক্ষালয়। আজ জানাজার কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য দাঁড়াননি; তারা দাঁড়িয়েছেন একটি সময়ের জন্য, একটি ইতিহাসের জন্য, একটি অসমাপ্ত রাজনৈতিক অধ্যায়ের জন্য। যিনি বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকলে এই দেশকে সত্যিকার উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে পারতেন।


বিজ্ঞাপন


স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হতো। ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হতো না। অথচ বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনকালে তাঁকে কতই না নিপীড়ন, অপবাদ ও নির্যাতনের শিকার হতে হলো!

জানাজা থেকে ফেরার পথে লালমাটিয়া আড়ংয়ের সামনে দাঁড়ালাম। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক [হয়তো কোনো এলাকার পদধারী নেতা] বলছেন, ‘আজ অনেকেই শোক জানাচ্ছেন, যারা তার স্লো-পয়জনিংয়ের সাথে জড়িত। বিস্ময়ে হতবাক হই। এই মেকি শোক জানানোওয়ালারা যদি এখন ক্ষমতায় থাকতো তাহলে ম্যাডামের জানাজা এরা ঢাকায় করতে দিতো না। তাঁর কবরটিও তারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার কবরের পাশে দিতে দিতো না।’

শুনে ভাবলাম। আজ যে কোটি জনতা জানাজায় অংশগ্রহণ করছে এটি দেখেও হয়তো অনেক শোক জানানো ওয়ালার ঈর্ষা, হিংসায়, পরশ্রীকাতরতায় রাতে ভালো ঘুম হবে না। তারপরও শোক জানিয়েছেন। এই মেকি আচরণ কেন? এই মোনাফেকির প্রয়োজন কী? এসব দেখে কাজী নজরুলের একটি গানের একটি চরণ মনে পড়ে গেল-‘ জীবনে যারে কভু দাওনি মালা,/ মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’।

02

সত্যিকার অর্থেই ম্যাডাম জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিয়সী নারী। কারণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ ছিল আকস্মিক, কিন্তু দেশ ও মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও দায়বোধের উৎকৃষ্ট কর্মকাণ্ডে রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান হয়ে উঠেছিল সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলেন, ম্যাডাম জিয়া হয়তো সাময়িক এক নাম। আবেগের ঢেউয়ে ভেসে ওঠা একজন উত্তরাধিকার। কিন্তু সময় প্রমাণ করেছে, তিনি ছিলেন কেবল উত্তরাধিকার নন। তিনি নিজেই বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির এক মহান শক্তি। বার বার ভাবছি। ক্ষমতা সবসময় সহজ নয়। ক্ষমতা মানেই সিদ্ধান্ত, ভুল, সমালোচনা এবং প্রতিপক্ষের অবিরাম আক্রমণ। বেগম জিয়ার শাসনামলে সাফল্য যেমন ছিল, বিতর্কও ছিল তেমন। তিনি কখনো প্রশংসিত হয়েছেন দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য, আবার কখনো সমালোচিত হয়েছেন অনমনীয়তার জন্য। কিন্তু ইতিহাস একপাক্ষিক নয়। ইতিহাস সেই সব বিতর্কের ভেতর দিয়েই এই মহান নেত্রীর অনমনীয়তাকে ‘আপসহীন’ অভিধায় ভূষিত করে একজন সর্বজনগ্রাহ্য নেতার প্রকৃত অবয়ব এঁকেছে। সবকিছু বাদ দিয়ে আজ শোকের দিনে বিচার নয়, স্মরণ করতে চাই। তিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। তিনি আমাদের চেয়ে কোটিগুণে বাংলাদেশ প্রেমিক। এদেশের মানুষকেই তিনি আত্মার আত্মীয় বানাতে পেরেছিলেন। তাই আজকের দিনে তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিচার করার দিন নয়। আজ হিসাব মেলানোর সময় নয়। আজ স্মরণ করার দিন। একটি জাতির সভ্যতা পরিমাপ করা হয়, সে তার মৃত নেতাদের কীভাবে স্মরণ করে তা দিয়ে।

Janaja4

জানাজা কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি সম্মিলিত বিদায়ের মুহূর্ত। আজ যারা কাতারে দাঁড়ালেন, তাদের অনেকেই হয়তো জীবনে কখনো বেগম জিয়াকে ভোট দেননি, সমর্থন করেননি। তবু তারা দাঁড়ালেন। কারণ মৃত্যু রাজনীতির ঊর্ধ্বে। এই দাঁড়িয়ে থাকাই জাতির পরিণত হওয়ার প্রমাণ। বেগম জিয়ার বিদায়ে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায় শেষ হলো। কিন্তু একই সঙ্গে অনেক প্রশ্নও সামনে এলো। আমরা কি ভিন্নমতকে শত্রুতা থেকে আলাদা করতে পেরেছি? আমরা কি বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখাতে শিখেছি? নাকি রাজনীতি আমাদের এতটাই নিষ্ঠুর করে তুলেছে যে মৃত্যুর পরও বিভাজন টিকে থাকে? আজকের শোক যদি আমাদের এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি না করে, তবে এই শোক অর্থহীন হয়ে যাবে। রাজনীতি মানুষকে বিভক্ত করতেই পারে, কিন্তু মৃত্যু মানুষকে একত্র করে। এই পরম-সত্যটি যদি আমরা ভুলে যাই, তবে আমাদের গণতন্ত্র কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আজ জানাজার কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ ইতিহাসের অংশ। দেখলাম, কেউ চোখের জল লুকাচ্ছেন, কেউ নীরবে তাকিয়ে আছেন, কেউ স্মৃতিচারণ করছেন। এই মুহূর্তগুলোই ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। তারা নিশ্চয়ই লিখবেন। একটি জাতি কীভাবে তাঁর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক নেত্রীকে বিদায় জানিয়েছিল। তাই বেগম খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়। তা হলো- ক্ষমতা আসে, ক্ষমতা যায়; কিন্তু মানুষের প্রতি আচরণ থেকে যায় ইতিহাসে। দেশের প্রতি ভালোবাসা শাশ্বত হয়ে রয়। জনপ্রেম নেতাকে অমরত্ব দেয়। সবকালে। সবখানে। সবসময় সর্বত্র। আজ যদি আমরা তাঁর মতো শালীন হই, সংযত হই, মানবিক হই, তবে এই শোক আমাদের পরিণত ও পূর্ণ মানুষ করবে। শোকস্তব্ধ এই দিনে, বেগম খালেদা জিয়ার জানাযার কাতারে দাঁড়িয়ে সব রাজনীতিবিদ যেন নিজের বিবেকের দিকেই একবার ফিরে তাকায়। ম্যাডাম জিয়া আমাদের এই দেশের স্বাধীনতার প্রতীক, দেশপ্রেমের ও অনুপ্রেরণার অনন্য বাতিঘর। আল্লাহ ওনার জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর