পূর্ণ শক্তি নিয়ে দেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। রোববার দিবাগত রাত পৌণে ৯টায় আছড়ে পড়ে ঝড়টি। এরপর থেকে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনাসহ বেশকিছু জেলায় তাণ্ডব চালিয়েছে রেমাল। জলোচ্ছ্বাসে ডুবেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। তবে এতে শেষ নয়, এই অবস্থা চলতে পারে আরও কিছুক্ষণ।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে— রেমালের কেন্দ্র দেশের উপকূল অতিক্রম করেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে প্রবল থেকে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে এটি। তবে ঘূর্ণিঝড়টির পুরো প্রভাব শেষ হতে সময় লাগতে পারে আরও ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেইলের প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে— ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব বেশি পড়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। রাতভর দেশের দক্ষিণ উপকূলে তাণ্ডব চালিয়েছে ঝড়টি। মধ্যরাত থেকে ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে তলিয়েছে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরের বেশকিছু বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙেছে গাছ পালা, বাড়িঘর ও বেড়িবাঁধ।
খুলনা: ভারী বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে খুলনা নগরের নিম্নাঞ্চল। বিভিন্ন এলাকায় উপড়ে পড়েছে গাছপালা। খুলনা শহর ও জেলার প্রায় পুরোটাই বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে নগরের মুজগুন্নী, লবণচরা, মোল্লাপাড়া, টুটপাড়া, মহিরবাড়ি খাল পাড়, শিপইয়ার্ড সড়ক, চানমারী বাজার, রূপসাসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনো ওই সব সড়কে পানি আছে। আজ সকাল ৯টার দিকে খুলনা শহরে বাতাসসহ বৃষ্টি হচ্ছে। শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় যানবাহন ও জনমানবশূন্য।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত খুলনা নগরে ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সকাল ৭টা থেকে নয়টা পর্যন্ত ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল এখনো খুলনা অঞ্চল ছেড়ে যায়নি। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ সারা দিন দমকা বাতাসসহ বৃষ্টি চলবে। আগামীকাল মঙ্গলবার (২৭ মে) পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে খুলনার দাকোপ উপজেলায় জোয়ারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে যায়।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ক্ষীতীশ গোলদার আজ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বলেন, এত উঁচু জোয়ার আগে তিনি দেখেননি। ঢাকি ও শিবসা নদীর মোহনায় কামিনীবাসিয়া পুরাতন পুলিশ ক্যাম্প-সংলগ্ন ওই এলাকায় বেড়িবাঁধের অংশ খুব বেশি দুর্বল ছিল না। তবে বেশ কিছুটা নিচু হওয়ায় উচ্চ জোয়ারের চাপে পানি বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে ভেতরে ঢোকে। এরপর বেড়িবাঁধের পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে যায়।
বরগুনা: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বরগুনার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে জেলা শহরসহ সেখানকার উপকূলের অনেক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলা এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পালের বালিয়াতলী ও বদরখালী ইউনিয়নের বাওয়ালকর এলাকায় বাঁধ ভেঙে ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে আঘাত হানে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে বরগুনায় ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়, গাছ উপড়ে পড়ে। বরগুনা সদর উপজেলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশের খালে অস্বাভাবিক পানি বেড়েছে।’
ভোলা: গতকাল ঝড়, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন ভোলার উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। ভোলার বিভিন্ন এলাকায় গতকাল দিনের চেয়ে রাতে ঝড়বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বেশি হয়েছে। এখনো বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে।
গত রাতে ঘুমাতে পারেননি ভোলার মনপুরা উপজেলার দুর্গম কলাতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মোসলেহ উদ্দিন। তিনি বলেন, গতকাল দিন ও রাতের জোয়ারে ঘরে গলাসমান পানি উঠেছে। ঘরের খাটের ওপর দাঁড়ানোর অবস্থা ছিল না। বাড়ির আশপাশের সব ফসল লোনাপানিতে ডুবে গেছে। তার দুটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
কলাতলী ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, তার ইউনিয়নের চারপাশে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে কোনো বাঁধ নেই। ফলে জোয়ারের পানি উঠে ফসল-মাছের ক্ষতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা: দমকা বাতাসের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টির কারণে কিছু কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে, উপড়ে পড়েছে গাছপালা। কিছু চিংড়িঘেরও ভেসে গেছে। শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, তারা সারা রাত শ্যামনগর-কালীগঞ্জ সড়কের ওপরে ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা চালু রেখেছেন।
যশোর: ঝড়ো ও দমকা বাতাসের কারণে গতকাল রাত ১২টা থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। আজ সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুতের দেখা মেলেনি। গতকাল রাত ১০টার পর থেকে যশোর শহরে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১২টার দিকে বাতাসের গতিবেগ বাড়লে গোটা শহরের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা কলেজের শিক্ষক অমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘রাত ১১টা থেকে বিদ্যুৎ নেই। অন্তত ১১ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছি। শৌচাগারে জল নেই। পানির মোটর চালানো যাচ্ছে না। খুব দুর্ভোগে পড়েছি।’
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক অমূল্য কুমার সরকার বলেন, ‘রাতে ঝড়ের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। সকাল থেকে মেরামতের কাজ চলছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’
পটুয়াখালী: গতকাল রাতে জেলায় জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের তীব্রতা শুরু হয়। প্রবল বেগে বাতাসের সঙ্গে প্রবল বর্ষণ এখনো আছে। কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের জালালপুর, খ্রিষ্টানপল্লি, পশ্চিম হাজিপুর, নবীপুর, ফতেহপুরসহ পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল রাত ১২টার সময় জোয়ারে জালালপুর গ্রামসংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর থেকে পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এ কারণে এখানকার পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়।
কুয়াকাটা সৈকত এলাকা এখনো ছয়-সাত ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। কুয়াকাটার নিকটবর্তী পশ্চিম খাজুরা এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির বাইরের অংশ এবং সাগর মোহনার মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর গ্রামসংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটিও জোয়ারের চাপে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিক মুন্সী বলেন, বাঁধের ঢালের ক্ষতি হয়েছে। আবার জোয়ারের চাপ বাড়লে বাঁধটি ছুটে যেতে পারে।
গতকাল সন্ধ্যা থেকে কলাপাড়া উপজেলা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। এর ফলে জনজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। পল্লী বিদ্যুতের কলাপাড়া কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক সজীব পাল বলেন, ‘ঝড়ে বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে, খুঁটি উপড়ে পড়েছে। এগুলো ঠিক না করে বিদ্যুৎ সঞ্চালনব্যবস্থা সচল করা যাচ্ছে না।’
বাগেরহাট: গতকাল রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টি আর থেমে থেমে দমকা বাতাস এখনো অব্যাহত আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ঝড়ো বাতাস আগের কোনো ঘূর্ণিঝড় দেখেননি তারা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে গাছপালা পড়ে সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন রয়েছে পুরো বাগেরহাট। শহরাঞ্চলে আজকের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছে ওজোপাডিকো। তবে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ–সংযোগের আওতায় আনতে আরও সময় লাগতে পারে।
আরও পড়ুন
রেমালের ব্যাপক তাণ্ডবে তছনছ উপকূল
গতকাল রাত থেকে জেলার নদ-নদীগুলার পানি আরও বেড়েছে। জেলার অন্তত তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বাঁধ উপচে পড়া জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ১০০ গ্রাম। তলিয়ে গেছে বসতঘর, রান্নাঘরসহ গৃহপালিত পশুপাখির থাকার জায়গাগুলো। জোয়ারের পানিতে জেলার কয়েক হাজার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত চার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী আছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেমাল এখন খুলনা ও কয়রার দিকে আছে। এখনো এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় অবস্থায় আছে। তবে দুই ঘণ্টার মধ্যেই এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। এরপর এটি নিম্নচাপে পরিণত হবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পুরোপুরি শেষ হতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ সারাদেশেই বৃষ্টি হবে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে— দীর্ঘ সময় তাণ্ড চালিয়ে বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে রেমাল। ফলে বিপৎসংকেত কমানো হয়েছে নদী ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে।
এইউ