প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। গেল বছরের ২৪ অক্টোবর দেশে হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ঘূর্ণিঝড়টি সারাদেশে ব্যাপকভাবে প্রভাব না ফেললেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা বেশ ক্ষতির মুখে পড়েন। তবে অতীতের বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পায় দেশ। বিংশ শতাব্দীতেই কয়েকটা ভয়াবহ দুর্যোগের ঘটনা ঘটে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঝড়টিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। রেডক্রসের হিসাবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও সরকারিভাবে ছয় হাজার বলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা। এতে প্রায় দুশোর মতো প্রাণহানি ঘটে। বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বৈশ্বিক নানা কারাণে পরিবর্তন হচ্ছে আবহাওয়া ও জলবায়ু। ইতোমধ্যে যার প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহভাবে বাড়ছে তাপমাত্রা। চরম হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা যে সময়ের মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের ধারণা দিয়েছিলেন তারও আগে পরিবর্তন হচ্ছে বৈশ্বিক আবহাওয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ এককভাবে নয়, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে পুরো বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবে যে দেশ যতো বেশি সচেতন হবে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সেই দেশে ততো দেরিতে পড়তে পারে।
বিজ্ঞাপন
ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্ব্যব্যাপী বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাখ লাখ লোক পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তারা অবশ্য এ কথাও বলে আশ্বস্ত করেছেন, উন্নত পরিবেশ, দূষণরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব হতে পারে। ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ৬০ জনের একটি আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকার এ জরিপ কার্যক্রম চালায়। ওই জরিপে বলা হয়েছে, উপকূলের ব্যাপক এলাকা সাগরের স্ফীত পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হবে। মিষ্টি পানির প্রবাহে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। উপকূলীয় ব্যাপক এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপও বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ৮টি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে এই দেশগুলো।
এছাড়াও বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রিন হাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ার কোনো প্রবণতা নেই বলে গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় দেশের তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেটার মূলে রয়েছে ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এটা চলমান অবস্থায় আছে। আমরা যদি দেখি প্রি ইন্ডাস্টিয়াল সময়টাতে বিশেষ করে ১৯৫০ সালের পর যে তাপমাত্রাটা ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা যাতে না বৃদ্ধি পায় সেজন্য বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো কমিটমেন্ট করেছিল। কমিটমেন্টে এটা ছিল যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা যেন না বাড়ে। কিন্তু ২০২৩ সালের মাথায় দেখা যাচ্ছে যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। সে হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ধারণা করা হয়েছিল বিশ্বের তাপমাত্রা যদি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে আধা মিটার। এতে করে বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৫ ভাগ এলাকা বেশি প্লাবিত হবে। আবার লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিস্থিতি আমাদের জন্য সুখকর নয়। যে হিসেবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা যদি চলতে থাকে তবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্রের জন্য তা হুমকি তৈরি করবে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল যেমন প্লাবিত হবে, সেই সমস্ত এলাকার মানুষজন যখন নগর অঞ্চলে মাইগ্রেট করবে তখন স্বল্প ভূমির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। নগরের পরিবেশ নষ্ট হবে। আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দ্বীপ অঞ্চল যেগুলা আছে যেমন সেন্টমার্টিন, ভোলা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া এগুলা চরম ক্ষতিগ্রস্থ বা বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এর জন্য বন উজাড়কেই প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশকে সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারি হিসাব মতে শতকরা ৯ ভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বনভূমির পরিমাণ ৬ ভাগের বেশি হবে না বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দেশে বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীতে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। যদিও পরিবেশবাদীরা এর বিপক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যচ্ছেন তার পরে এই কাজ অব্যাহত থাকতে দেখা গেছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশি করে গাছ লাগাতে জোর তাগিদ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
টিএই/এএস