রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে সর্বত্রই গত কয়েকদিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ২৮ অক্টোবর। সবার প্রশ্ন ছিল কি হতে পারে এইদিন? অনেকে ২০০৬ সালের এই দিনের রাজনৈতিক সংঘাতের মতো বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের কর্মসূচি থাকায় সহিংসতা হতে পারে এমন আশঙ্কাও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যি হলো।
শনিবার (২৮ অক্টোবর) পুলিশ ও বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে জড়িয়েছে আওয়ামী লীগও। এতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে এক পুলিশ ও যুবদল নেতার।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য দুপুর অবধি টানটান উত্তেজনা থাকলেও কোথাও কোনো ধরণের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে ব্যাপক সংঘর্ষের জেরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তিনটি বাসে। কাকরাইল থেকে শুরু করে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কের পাশের বিভিন্ন ভবন, অনেকগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। রাস্তার আইল্যান্ডের লোহার বেরিকেড ভেঙে ব্যবহার করা হয়েছে সংঘর্ষে।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের এবং পুলিশের অনেক সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। অনেককে আটক করা হয়েছে। মহাসমাবেশের হামলার প্রতিবাদে বিএনপি দীর্ঘদিন পর হরতালের ডাক দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরের এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল তা বেড়ে যাবে। সামনে বিরোধী দলগুলো হরতালসহ অন্য কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। তাতে দেশব্যাপী সহিংসতার আশঙ্কা আছে।
গত ১৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। পরে একইদিনে বাইতুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করার ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে এ নিয়ে বাকযুদ্ধ চলে নিয়মিত। এরমধ্যে আগুনে ঘি ঢালে জামায়াত। তারাও একইদিনে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে শুরু থেকে জামায়াতকে অনুমতি না দেয়ার কথা জানায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের পছন্দের জায়গায় কর্মসূচি করতে অনড় থাকায় শুক্রবার শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়।
অবশ্য পুলিশের অনুমতি পাওয়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি আর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি কেউ।
অনুমতি না পেলেও যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়ায় বেশি আতঙ্ক ছিল জামায়াত ইসলামীকে ঘিরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরো কোনঠাসা থাকা দলটির নেতাকর্মীরা অনুমতি ছাড়াই পুলিশি বেষ্টনির মধ্যে সমাবেশ করে শান্তিপূর্ণভাবে এলাকা ছেড়েছে। তবে ভয়াবহ সংঘাত হয়েছে বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে। আওয়ামী লীগের সমাবেশেও হামলার খবর পাওয়া গেছে। কর্মসূচি শেষে দলটির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
নয়াপল্টনে ছিল উৎসবের আমেজ
মহাসমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ২টা। ১২টা থেকে কর্মসূচি শুরু করার কথা থাকলেও শনিবার ভোর থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মী জড়ো হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর, বিজয়নগর সেগুনবাগিচা এলাকার অলিগলিতে শুধু মানুষ আর মানুষ। কোথাও তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
ট্রাকে করে কেউ বিতরণ করছেন পানি, কেউ দিচ্ছেন কলা-রুটি, কেউ দিচ্ছেন প্যাকেট খাবার। কেউ আবার সড়কে প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে মহাসমাবেশের বক্তব্য শুনছেন। কেউ আবার সরকারবিরোধী নানা স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে রাখেন।
পরে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপির মহাসমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে। রাতেই ট্রাক দিয়ে মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়।
সমাবেশ চলাকালে দুপুরের দিকে সংঘর্ষ বাধে নেতাকর্মীদের সঙ্গে। কাকরাইলে বিচারপতিদের ভবনের সামনের সড়কের সংঘর্ষ এক পর্যায়ে সংঘাতে রূপ নেয়। যা চলে বিকেল পর্যন্ত।
এক পর্যায়ে সমাবেশ দ্রুত শেষ করে বিএনপি। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে হরতালের কর্মসূচি করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এসময় পরবর্তী কর্মসূচি কি হবে- সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন আমরা স্থায়ী কমিটির মিটিং এ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। তবে উপস্থিত নেতাকর্মীরা তখনই পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য অনুরোধ করলে রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।
এর আগে, সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে এই সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পুলিশ বাহিনী একের পর এক গুলি হামলা করে আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কে পণ্ড করেছে। আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর অনুরোধ করছি।
শক্তি জানান দিয়েছে আওয়ামী লীগ
এদিকে সকালের দিকে লোকজন কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের ঢল নামে বাইতুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। বেলা ১১টার সময় আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের নিদের্শনায় সাংস্কৃতিক উপকমিটির সদস্যরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দুপুর ২টার দিকে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে সমাবেশস্থল।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মিছিল আর স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট, গুলিস্তান, জিরো পয়েন্টসহ আশপাশের এলাকা। বিকেল তিনটায় সমাবেশস্থলে হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিএনপি হামলা চালিয়েছে। এসময় নুর হোসেন চত্বরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর মধ্যে মারামারি, লাঠি-ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মাইক নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের শান্ত করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন।
পরে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ করে আওয়ামী লীগ। অবশ্য তখনও বিএনপির সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। সমাবেশ শেষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মিছিল করে অলিগলি থেকে অনেককে ধরে এনে মারধর করে।
অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করল জামায়াত
অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও শাপলা চত্বরে সমাবেশ করতে অনড় ছিল জামায়াতে ইসলামী। তবে পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে শাপলা চত্বরে যেতে পারেননি দলটির নেতা-কর্মীরা। পরে বেলা ২টা ২০ মিনিটে নটর ডেম কলেজের সামনে সমাবেশ করা হয়। পিকআপের ওপর মঞ্চ করা হয়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষ হয় ৩টা ১০ মিনিটে।
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর মুক্ত আকাশে সমাবেশ করছে জামায়াতে ইসলামী। আজ সেই ২৮ অক্টোবরে যেদিন লগি-বইঠা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছিল। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই। তবে হত্যার বদলে হত্যা নয়। কোরআন ও সুন্নাহর আইন চালু করে প্রতিশোধ নেব।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে আরামবাগ মোড়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বড় জমায়েত দেখা যায়। তারা সেখানে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
জামায়াত ঘোষিত কর্মসূচি সামনে রেখে সকালে আরামবাগ মোড়ে একটি ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। আরেকটি ব্যারিকেড দেওয়া হয় মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে নটর ডেম কলেজের দিকে যাওয়ার পথে। পুলিশি ব্যারিকেডের কারণে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আরামবাগ মোড় পার হতে পারছিলেন না। বেলা পৌনে একটার দিকে আরামবাগ মোড়ের পুলিশি ব্যারিকেড ভাঙেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। পরে আরামবাগ মোড় থেকে নটরডেম কলেজ পর্যন্ত এলাকার সড়কে তারা অবস্থান নেন। বেলা ২টা ২০ মিনিটে আরামবাগ মোড়ে সমাবেশ শুরু করেন।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, আজকের সহিংসতার মধ্য দিয়ে আপাতত দৃষ্টিতে কঠোর কর্মসূচির মধ্যে প্রবেশ করল বিরোধী রাজনৈতিক দল। আবার সহিংসতাও বাড়ার আশঙ্কা বাড়ল। এটা বাড়লে তা দেশের জন্য, জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না। সরকারের জন্যও ভালো হবে না। সহিংসতা বাড়লে অর্থনীতি ক্ষতি হবে।
এক্ষেত্রে করণীয় কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংলাপে সমাধান হয়নি তারপরও আলাপে বসতে হবে। কারণ সংলাপে টেকসই সমাধান হয়। রাজপথে সমাধান আসবে না।
বিইউ/এএস