দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেলে পেশ করা এই বাজেট নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে পাওয়া যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বড় আকারের এই বাজেট বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ করে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তবে শেষ পর্যন্ত এই বাজেট বাস্তবায়ন করা গেলে সামগ্রিকভাবে তা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তা অলীক এবং অর্জনযোগ্য নয়। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে যেসব উদ্যোগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞাপন
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানোর পর্যাপ্ত কোনো উদ্যোগ এই বাজেটে নেই। তবে ব্যক্তি করদাতা পর্যায়ে করমুক্ত আয়সীমা বিদ্যমান তিন লাখ টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে সিপিডি।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে। তারা জীবনধারণের জন্য যেসব পণ্য ক্রয় করে, সেগুলোর মূল্য সাধারণ মূল্যস্ফীতির চেয়ে দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাজস্ব বাড়াতে যেসব শিল্প পরিপক্ব হয়ে গেছে, সেখানে আর কর অবকাশ সুবিধা না দেওয়াই ভালো। মূল্যস্ফীতি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকবে বলে আশা করি। সংকটকালে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয়ের দিকে যাওয়া যাবে না। ব্যয়কে যৌক্তিক করে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে বাজারে অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম প্রয়োজনীয় অর্থপ্রবাহ এড়াতে হবে।
বিজ্ঞাপন
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে এবং একটা বড় অংশ সেখানে যাচ্ছে। এটা এই বাজেটের একটা ভালো দিক।
প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, কর আদায়ের লক্ষ্য পূরণ চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সাল এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের থেকে উত্তরণ) গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে বাজেট ঘোষণা করেছেন। সেখানে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে, কালেকশনটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমাদের ফরেন কারেন্সি যেহেতু এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের ফরেন কারেন্সির প্রাইসটা কোথায় পর্যন্ত যাবে আমরা জানি না। এগুলোকে যদি আমরা ঠিক রাখতে পারি...বাজেটে কালেকশন যদি না হয় তাহলে এক্সপেনডিচার তো ডিফিকাল্ট।'
অর্থমন্ত্রী আজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন। জাতীয় সংসদে 'দেড় দশকের উন্নয়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রগতি' শীর্ষক বাজেট বক্তৃতা দেন তিনি। এটি দেশের ৫২তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, টার্গেট অ্যাচিভ করতে হলে এক্সপেনডিচারে যেতেই হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের কালেকশন বাড়াতেই হবে। বাড়ানোর জন্য আমরা সব সময় যেটি বলি, এক জায়গায় সীমাবদ্ধ না থেকে জাল বিস্তৃত করা। সহজে যেসব জায়গা থেকে ট্যাক্স কালেকশন করা যায়—ভ্যাট সোর্স, অগ্রিম আয়কর (এআইটি), অ্যাডভান্স ভ্যাট; এগুলো কম করে বরং নতুনদের কারের আওতায় নিয়ে আসা।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণের সেবা কমে কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর (ডরপ)। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থার পক্ষে উপ-নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন, ‘এটি বড় ঘাটতির বাজেট। মূল্যস্ফীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সেবামূলক খাতে এর প্রভাব পড়বে। নানামুখী অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধি এবং করজাল যদি বিস্তৃত না করা হয় তাহলে বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা করা মুশকিল হতে পারে।’
ডরপ বলছে, ‘বাজেটে মৌলিক সেবা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা না হলে অন্যান্য উন্নয়ন খাতগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। তাই ন্যায্যতা, প্রয়োজনীয়তা ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু পানি ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জনগণের মৌলিক সেবা যেমন স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাই খাতটিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ একান্তভাবে জরুরি।’
অর্থমন্ত্রী আজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন। জাতীয় সংসদে 'দেড় দশকের উন্নয়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রগতি' শীর্ষক বাজেট বক্তৃতা দেন তিনি। এটি দেশের ৫২তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড়। বাজেটটি ৫০ লাখ ছয় হাজার ৬৭২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।
জেবি