অকুতোভয় জুলাই যোদ্ধা শহীদ শরীফ ওসমান বিন হাদি। এখন হাদি কেবল একটি নাম নয়—বিদ্রোহী এক কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের প্রতীক। শত হুমকি ও শত্রুর ভয় তাকে কখনও দমাতে পারেনি। দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বলতেন, ‘বুলেট ছাড়া কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।’ শেষ পর্যন্ত সেই বুলেটই তার মস্তিষ্ক ভেদ করে ঝরিয়েছে রক্ত— বাংলাদেশের বুকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার, সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর—এই পুরো পথে তার সঙ্গে ছিল কোটি মানুষের ভালোবাসা ও প্রার্থনা। তবে বীরের পথও একসময় শেষ হয়, যখন মহান আল্লাহর ডাক আসে।
বিজ্ঞাপন
হাদি নিজেও শহীদি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়ে শহীদি মৃত্যুতে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে, তাহলে আগামী এক হাজার বছর বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য নামাজে দোয়া করবে।’
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর) থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে তিনি ‘চা-শিঙাড়া আড্ডা’র মতো ব্যতিক্রমী কর্মসূচির আয়োজন করে আলোচনায় আসেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতার সমালোচনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। পুরোনো ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচক হাদির মতে, সেই ধারায় ক্ষমতায় এলে কেউ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না।
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার রাতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমবেত হন। এ সময় তারা ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘আমরা সবাই হাদিই হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘এক হাদি লোকান্তরে, লক্ষ হাদি লড়াই করে’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’, ‘ওই হাসিনা দেইখা যা, রাজপথে তোর বাপেরা’—এমন নানা স্লোগান দেন।
তার শাহাদাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শোকবার্তায় বলেন, শরীফ ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে তিনি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছেন। তার প্রয়াণ দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিসরে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত স্ত্রী, সন্তান, পরিবার ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। একই সঙ্গে তিনি জানান, শহীদ ওসমান হাদির স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে।
বিজ্ঞাপন
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানো হবে না। তার ভাষায়, বিপ্লবী রক্তে উজ্জীবিত তরুণ নেতা ওসমান হাদি ছিলেন প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ শোকবার্তায় বলেন, শরিফ ওসমান হাদির অকাল ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে দেশ এক সাহসী কণ্ঠস্বর হারাল। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আধিপত্যবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে শরিফ ওসমান হাদির সংগ্রামী ভূমিকা এ দেশের তরুণদের জন্য চিরদিন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তার অকালমৃত্যু সমাজ ও দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘শহীদ ওসমান হাদির রক্তের শপথ, আজ থেকে আমরা প্রত্যেকে ওসমান হাদি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে আমাদের কণ্ঠস্বর সমুন্নত থাকবে।’
ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক হাসান আজাদ বলেন, হাদি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এবং রাজনীতি কোনো বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার হতে পারে না। তিনি আজীবন দেশি-বিদেশি প্রভাব, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও গণতন্ত্রহীন শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, হাদির অনুপস্থিতি শুধু একজন নেতার শূন্যতা নয়, বরং একটি সাহসী রাজনৈতিক ভাষার অভাব। তার স্বপ্ন ছিল একটি ইনসাফের বাংলাদেশ—যেখানে রাষ্ট্র মানুষের বিরুদ্ধে নয়, মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
এদিকে, হাদির মৃত্যুতে শনিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে। একই সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্তও কার্যকর করা হয়েছে।
শরীফ ওসমান হাদি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মাদরাসা শিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় তার শিক্ষাজীবনের সূচনা। পরে ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদরাসা থেকে আলিম সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন—প্রথমে একটি ইংরেজি শেখার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস-এ। এই শিক্ষাগত পটভূমি ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাই তার রাজনৈতিক দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন। রামপুরা এলাকায় স্থানীয় সংগঠক ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি ছাত্র-জনতার মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এই অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক ধারার অন্যতম তরুণ স্থপতি হিসেবে ওসমান হাদির নাম উচ্চারিত হতে থাকে।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সংগঠক, সমালোচক ও পরিবর্তনের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন—যার পরিণতি হলো ইতিহাসের পাতায় শহীদ জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তার নাম অমর হয়ে যাওয়া।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন ওসমান হাদি। সেই বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করে ঝড় তুলতেন ময়দানে। অবশেষে নজরুলের পাশেই শায়িত হচ্ছেন জাতীয় বীর শরিফ ওসমান বিন হাদি।
টিএই/জেবি



















































































































