- কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় মৃত্যু প্রায় শতভাগ
- হাই ফ্লো অক্সিজেনেও চাহিদা পূরণ হয় না, প্রয়োজন হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বারের
- দেশে হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার আছে মাত্র চারটি
- গ্লাসের ভবন ও ইন্টেরিওর ডিজাইন বাড়াচ্ছে ঝুঁকি
- উদ্ধার কাজে জড়িতদের সঙ্গে অক্সিজেন বহনের সুপারিশ
বিজ্ঞাপন
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, লিপ ইয়ার। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নানা আয়োজনে মেতে উঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ। হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে ছিল বিশেষ ছাড়। আর এসব ছাড়ের রেস্টুরেন্টে বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে ভিড় করেন ভোজন রসিক মানুষেরা। এর ব্যাতিক্রম ছিল না রাজধানীর অভিজাত ও ভোজন বিলাসীদের জন্য পরিচিত স্থান বেইলি রোড। তবে মুহূর্তের মধ্যেই সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৪৬ জন। এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু আগুনে পুড়ে নয়, ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে হয়। যার পেছনে ছিল কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া। এ ঘটনায় আলোচনায় আসে আগুনে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ার বিষয়টি।
উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ও চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, এই ঘটনায় আগুনে পুড়ে যত না মানুষ মারা গেছে, তার চেয়েও বেশি মারা গেছে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায়। ঘটনার পরদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ার মারা গেছেন। আগুন লাগলে বদ্ধ ঘরে যখন কেউ বের হতে না পারে তখন সেখানে সৃষ্ট ধোঁয়া তাদের শ্বাসনালীতে চলে যায়। এখানেও প্রত্যেকেরই তাই হয়েছে। এই বিষক্রিয়া যাদের বেশি হয়েছে তারা কেউ বাঁচতে পারেননি। এমনকি যারা চিকিৎসাধীন আছেন তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন বলেও জানান প্রখ্যাত এই বার্ন সার্জন।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালে ভর্তি আহতদের এক্সটার্নাল বার্ন মারাত্মক নয়। তবে সবার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে এবং ইন্টার্নাল বার্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে কার্বন মনোক্সাইড ইনফেল করেছেন। এটি মারাত্মক বিষাক্ত। এটি ইন্টার্নাল অর্গানগুলোকে নষ্ট করে দেয়। অক্সিজেন গ্রহণে বাধা দেয়। ফলে যতক্ষণ না এই গ্যাস বের হচ্ছে রোগীরা শঙ্কামুক্ত নয়। যে কারণে স্পটে পাওয়া মৃতদের এক্সটার্নাল বার্ন খুব বেশি না থাকলেও মৃত্যু বেশি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
তারা জানান, কার্বন মনোক্সাইড একটি মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাস। এতে আক্রান্ত রোগীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে। সাত থেকে আট মিনিট এটি গ্রহণ করলে মানুষের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু না হলেও রোগীর কিডনি, লিভারসহ ইন্টারনাল অঙ্গগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে রোগীর মৃত্যুহার অনেক বেশি হয়ে যায়।
কতটা ভয়ংক কার্বন মনোক্সাইড?
এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক ও অনকোপ্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমেদের। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আগুন লাগলে বিশেষ করে ইন্টেরিওর ডিজাইন রয়েছে এমন কোথাও পুড়ে যাওয়ার আগেই ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ধরনের ঘটনায় রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। যদি কোনো কারণে কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া হয়, এটি খুবই বিপজ্জনক। কেননা এটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে ৭-৮ মিনিটও সময় দেয় না। আক্রান্ত ব্যক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। ওই ব্যক্তিকে হয়তো সজীব দেখা যায় কিন্তু হাসপাতালে আনার পরও এসব রোগীকে বাঁচানো যায় না। কারণ রোগীর কিডনি, লিভারসহ ইন্টার্নাল ডেমেজ হয়।
এই চিকিৎসক বলেন, এসব রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব আশেপাশের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কারণ সিলিন্ডারের অক্সিজেনে এই রোগীদের লাভ হয় না। সিলিন্ডারের ফ্লো (অক্সিজেন প্রবাহ) রেট হলো আট লিটার। অপরদিকে এ ধরনের রোগীদের প্রয়োজন হাই-ফ্লো অক্সিজেন। যেখানে একসাথে ৩০ থেকে ৩৫ লিটার যাবে। আমরা তাদের হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বারে ঢুকিয়ে দিই। কারণ হাই-ফ্লো অক্সিজেন দিয়েও কাজ হয় না। কেউ যদি চার থেকে পাঁচ মিনিট কার্বন মনোক্সাইড নিয়ে ফেলে তাকে বাঁচানো খুবই মুশকিল।
কার্বন মনোক্সাইড রোগীদের চিকিৎসা
ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। সারা বিশ্বের কোথাও চিকিৎসা নেই। আমাদের এখানে চারটা হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার রয়েছে। এগুলোকে একজন রোগীকে একসাথে ৭০ মিনিট অক্সিজেন দেওয়া যায়। হাইপারবেরিক চেম্বার দিয়েও আসলে রোগীদের বাঁচানো যায় না। কারণ যারা কার্বন মনোক্সাইডে আক্রান্ত হয় তারা হাসপাতালে আনতে আনতেই মারা যায়। আমাদের দেশে এমন সিস্টেম চালু করতে হবে, যেন কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলেই সাথে সাথে ফাস্ট এইড ব্যবস্থা হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সেবা দেওয়া যায়। ফায়ার বিগ্রেডসহ সবাইকে সাথে অক্সিজেন নিয়ে যেতে হবে। যেন উদ্ধারের পরই তা দেওয়া যায়। হাসপাতালে আনার অপেক্ষা করলে হবে না। এতে রোগীর চিকিৎসায় গোল্ডেন টাইম চলে যাবে।
মৃত্যুহার প্রায় শতভাগ জানিয়ে তিনি বলেন, করোনার আগে যুক্তরাজ্যে বড় একটি ভবনে আগুন লেগেছিল। যা ‘লন্ডন বার্ন ইনসিডেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি লিখে গুগলে সার্চ করলে বিস্তারিত জানা যায়। ওই আগুনের ঘটনায় সবাই স্পটে মারা গেছে। এমনকি হাসপাতালে নেওয়ার পরেও ৮০ শতাংশ রোগী মারা গেছে। যদিও আমাদের হাসপাতালে মৃত্যু শূন্য। বিদেশিরা এতে অবাক হয়েছে। আমাদের ধারণা, এটি হয়েছে রোগীদের সক্ষমতার জন্য। আমরা এমনিতে বিষাক্ত আবহাওয়াই বসবাস করি। ফলে আমাদের ফুসফুস অনেক বেশি বিষক্রিয়া সহ্য করতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডে কার্বন মনোক্সাইড থেকে বাঁচতে করণীয় কী?
কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ার ধরন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা থেকে স্পষ্ট যে, প্রতিরোধই এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। কিন্তু আগুন লাগার মতো তড়িৎ ঘটনায় কী কারণীয় সাধারণ মানুষের? জানতে চাইলে ডা. তানভীর বলেন, কোনো দুর্ঘটনায় ধোঁয়া উঠছে দেখা গেলে এবং আশপাশে বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে ফ্লোরে শুয়ে পড়তে হবে। কারণ ধোঁয়া উপরে উঠে। যেদিকে দরজা খোলা আছে, সেদিকে যেতে হবে। যদি গ্লাস থাকে সেক্ষেত্রে তা ভেঙে ফেলতে হবে।
গ্লাসের ব্যবহার বাড়া ও নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাইরের দেশগুলোতে বাসসহ যেখানে কাঁচের দরজা-জানালা রয়েছে সেখানে ছোট একটা হাতুড়ি রাখা থাকে। যা আমাদের দেশে কোথাও নেই। প্রতিনিয়ত ভবনে কাচের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু বিপদে তা ভাঙার কোনো ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। একইসঙ্গে বাড়ছে ইন্টেরিওর ডিজাইনের প্রবণতা। এ অবস্থায় সতর্কতা হিসেবে পাতলা ইন্টেরিওর ডিজাইন করতে হবে। ইন্টেরিওর ডিজাইন রয়েছে এমন স্থান, যেমন গণমাধ্যমের স্টুডিওতে কমপক্ষে তিনটি দরজা রাখতে হবে।
এমএইচ/জেবি