রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ৪৪টি লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর দুজনের লাশ ডিএনএ টেস্ট করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
শনিবার (০২ মার্চ) দুপুরে ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের অফিসার ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মো. বাচ্চু মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
বাচ্চু মিয়া বলেন, দুজনের লাশ এখনো মর্গে আছে। ডিএনএ টেস্টের মধ্যমে পরিচয় শনাক্ত হলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আজ সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কাস্টমস কর্মকর্তা শাহ জালাল উদ্দিন (৩৫), তার স্ত্রী মেহেরুন নেসা হেলালী (২৪) এবং তাদের মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিলার (৪) মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ৪০ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে থাকা সাংবাদিক অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির লাশ আঙুলের ছাপের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার হস্তান্তর করা মরদেহর মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর মগবাজারের সৈয়দ মোবারক হোসেন (৪৮), তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার (৪১), দুই মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা তুজ জহুরা কাশপিয়া (১৬), আমেনা আক্তার নূর (১৩) ও ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ (৮)। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা লুৎফুর নাহার করিম লাকী (৪৭) ও তার মেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতি তাজরিন নিকিতা (২১)। শান্তিবাগ এলাকার পপি রায় (৩৩) এবং তার মেয়ে সম্পূর্ণা পোদ্দার (১২) ও ছেলে সংকল্প সান (৮)।
মতিঝিল আরামবাগের নাজিয়া আক্তার (৩১) তার দুই সন্তান আয়ান (৮) ও আয়াতকে (৬) নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন ওই ভবনে। দুই সন্তানকে নিয়ে মারা যান মা। তাদের মরদেহ নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। এছাড়া একই পরিবারের মতিঝিল এজিবি কলোনির আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা মেহরান কবির দোলা (২৯) এবং তার ছোট বোন মাইশা কবির মাহি (২১)। তারা দুই বোন সেখানে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন।
কাকরাইলের ফৌজিয়া আফরিন রিয়া (২২) ও সাদিয়া আফরিন আলিশা (১৩)। তারা দুই বোন। ফৌজিয়া আফরিন মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। শুক্রবার তার মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সাদিয়া আফরিন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের বাবার নাম কোরবান আলী। তাদের সঙ্গে খালাতো বোন নুসরাত জাহান নিমু (১৯) ছিলেন। একসঙ্গে ভবনটিতে রাতের খাবার খেতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন তারা। তাদের সবার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। আজ স্বজনেরা লাশ নিয়ে যান।
অপরদিকে, বেইলি রোডে আগুনের প্রাণ হারানোর তালিকায় রয়েছেন দুই নারী দাবাড়ুর মা শম্পা সাহা (৪৫)। তার দুই মেয়ে শ্রেয়া পোদ্দার ও প্রজ্ঞা পোদ্দার বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের রেটিং ও নারী দাবার অনেক টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নেন। মেয়েরা বর্তমানে কানাডায় থাকেন। শম্পার বাসা মৌচাকে। ঘটনার দিন তিনি একাই ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। তার মরদেহ নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। মেয়েরা দেশে এলে সৎকার করা হবে।
খিলগাঁওয়ের আশরাফুল ইসলাম আসিফ (২৫) ও তুষার হাওলাদার (২৩), বংশালের নুরুল ইসলাম (৩২), নারায়ণগঞ্জের শান্ত হোসেন (২৪), মাদারীপুরের মোহাম্মদ জিহাদ (২২), যশোরের কামরুল হাসান রকি (২০), ভোলার দিদারুল হক (২৩), মৌলভীবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীম (৬৫), টাঙ্গাইলের মেহেদী হাসান (২৭), মুন্সীগঞ্জের জারিন তাসনিম খান প্রিয়তি (২০) ও গুলশানের জুয়েল গাজীর (৩০) লাশ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন।
ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী পাবনা ফরিদপুরের সাগর হোসেন (২৪), পিরোজপুরের তানজিলা নওরিন এশা (৩৫) ও শেরপুরের শিপন (২১), বুয়েট শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন (২০) ও লামিশা ইসলাম (২০)। লামিশার বাবা নাসিরুল ইসলাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদে কর্মরত। এ ছাড়া বরগুনার ছেলে নাঈম (১৮)। ভোলা সদরের সিরাজুল ইসলামে ছেলে নয়নের (১৭) লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে একজন সংবাদকর্মীর মরদেহ শনাক্ত হলেও তার অভিভাবক নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। পরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষার পর মেয়ে দাবি করা তার বাবা-মায়ের কাছেই মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এছাড়া বার্ন ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ভর্তি আছেন—ফয়সাল আহমেদ (৩৮), সুজন মন্ডল (২৪) প্রহিত (২৫) আবিনা (২৩) রাকিব হাসান (২৮) কাজি নাওশাদ হাসান আনান (২০), আজাদ আবরার (২৪), মেহেদী হাসান (৩৫), রাকিব (২৫) ও সুমাইয়া (৩১), জহিরুল (২৬) এবং ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন ইকবাল হোসেন (২৪), ও যোবায়ের (২১)।
২৯ ফেব্রুয়ারি রাত রাত পৌনে ১০টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ আগুন লাগে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো সাততলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে। ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট ছিল।
এরমধ্যে আগুনে হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে দ্বিতীয় তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। এ রেস্টুরেন্ট থেকে কমপক্ষে ১৫টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ভবনটির নিচতলায় চায়ের চুমুক নামে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পরে মুহূর্তে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। মাত্র এক মাস আগে ভবনটির নিচতলায় চায়ের চুমুক রেস্টুরেন্টটি যাত্রা শুরু করেছিল।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, গ্রিন কোজি কোটেজ নামে ভবনটির ডেভেলপার আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। ভবনটির সব ফ্লোর ব্যবহার হচ্ছিল বাণিজ্যিকভাবে। তবে রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহারের কোনো অনুমতি ছিল না এ ভবনের।
এদিকে, ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় মামলা করা করেছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে রমনা থানা পুলিশ বাদী হয়ে করা ওই মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।
এর আগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনটিতে অবস্থিত চায়ের চুমুকের দুই মালিক ও কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তথ্য জানতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে আরও কয়েকজনকে।
এমআইকে/এএস