সারাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভিড় বেড়েই চলেছে। সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ডেঙ্গু নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গর্ভবতী নারীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন গাইনি চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে গর্ভবতী নারীর পাশাপাশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে তার অনাগত সন্তানও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্টেট্রিকস ও গাইনোকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তৃপ্তি রানী দাস ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সবসময় এই জ্বরের বিষয়ে গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারকে সতর্ক থাকতে বলি। শুধু ডেঙ্গু নয়, যেকোনো জ্বরই গর্ভবতীদের জন্য বিপদজনক। গর্ভবতী মায়ের শরীরের তাপমাত্রা কোনোক্রমেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। এতে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
গর্ভবতী নারীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে করণীয় এবং ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ডেঙ্গু হোক, ম্যালেরিয়া হোক, টাইফয়েড হোক বা করোনা হোক— মাথায় রাখতে হবে, জ্বর যদি ১০১ ডিগ্রির ওপরে যায় তখন বাচ্চারও পালস রেট, হার্টবিট বাড়ে। তখন আমরা বলি বাচ্চাটা ডিসট্রেসে আছে। আবার যখন হার্টব্রিট কমে তখনও বলি ডিসট্রেসে আছে। এটিকে সমবসময় নিয়মে রাখতে হবে। দুজনের জন্যই কিন্তু শরীরের অধিক তাপমাত্রা ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে রক্তকণিকা কমে যায়, প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গেলে মায়েরও বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। নরমাল মানুষের নাখ, মুখ, পায়খানার রাস্তা দিয়ে যেমন রক্তপাত হয়, তেমনি গর্ভবতী মায়ের মাসিকের রাস্তায় রক্তপাত হতে পারে। প্রেগনেন্সিতে ডেঙ্গু হলে ওই মায়ের বাচ্চা গর্ভপাত, সময়ের আগে ডেলিভারি বা গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু— তিনটাই হতে পারে যদি আমরা সঠিক সময়ে প্রতিরোধ করতে না পারি বা ডেঙ্গুর চিকিৎসা ঠিকমতো দিতে না পারি।
ডেঙ্গুর জন্য আমরা বলি, ব্লাড প্রেসার ধরে রাখতে হবে, টেম্পারেচার হাই হলে তা কমিয়ে রাখতে হবে। ব্লাড প্রেসার কমে গেলে বাচ্চার ফুল সঠিক জায়গা থেকে ছিড়ে যায়। আমরা যদি টেককেয়ার না করি প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গেলে সাধারণ মানুষের যে ক্ষতি হয় গর্ভবতীদের ক্ষতি আরও বেশি। প্রথম কাজ হলো ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। যদি না করতে পারি তাহলে দ্রুত ডায়াগনসিস করবে। মায়ের টেম্পারেচার ১০১ এর উপরে বাড়তে দেব না, ব্র্যাড প্রেসার কমতে দেব না। কোনোভাবেই প্লাটিলেট কমতে দেব না। ৫-৭ দিনের মধ্যেই কিন্তু রোগীর অবস্থা খারাপ হয়। তাই সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
বিজ্ঞাপন
গর্ভবতী মা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথম তিনমাসে ডেঙ্গু হলে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পরে হলে সময়ের আগে ডেলিভারি হতে পারে। তাই সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ ইনফার্টিলিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও এভারকেয়ার হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক এসএম খালেদুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গু একটা ভাইরাস জ্বর। সাধারণ মানুষের যখন নানা কষ্ট হয় তখন একজন গর্ভবতীর আরও বেশি সমস্যা হতে পারে। গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারকে সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে যেন সামান্য ভুলে বড় কোনো অসঙ্গতি দেখা না দেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক গাইনি চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে চার থেকে পাঁচদিন বা তারও বেশি প্রচণ্ড জ্বর থাকে। গাইনি চিকিৎসকরা আরও বলেন, যেকোনো জ্বরেই আমাদের শরীরের রক্তনালীগুলো প্রসারিত হয়ে যায়। ফলে মায়ের কাছ থেকে বাচ্চার শরীরে ব্লাড যাওয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। যেহেতু ফ্লো কমে যায়, তার মানে বাচ্চার শরীরে সবকিছু কম যাবে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাটা আক্রান্ত হতে পারে। জ্বরে সাধারণ রোগী যতটা দুর্বল হয় গর্ভবতী মা তারচেয়ে অনেক বেশি দুর্বল হয়।
মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাসরিন সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেন, গর্ভবতী মায়ের জ্বরের কারণে বাচ্চার জন্মগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গুর কারণে মায়ের অবস্থা অর্গান ডেমেজের মতো খারাপ হলে বাচ্চার অবস্থাও খারাপ হবে। তিনি বলেন, যত দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া যায় ততই উত্তম। পরিবারের অন্যদেরও মায়ের যত্নে সতর্ক থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, গর্ভকালীন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় একদিকে যেমন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, অন্যদিকে ডেঙ্গুর জটিলতা এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। গর্ভবতী মা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে মা ও গর্ভস্থ সন্তানের জীবনে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলেই গর্ভবতী মাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যদি ডেঙ্গু নিশ্চিত হয়, তবে গর্ভবতী মাকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
মিডফোর্ড হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় যদি কোনো মায়ের প্রসব বেদনা শুরু বা জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তখন এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এজন্য আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে।
ডব্লিউএইচ