মশা বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত প্রসঙ্গ। হঠাৎ করে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু জ্বরে অধিক হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একটি ছোট্ট জীব কীভাবে মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে মশা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এখানে আমরা দেখে নেব- পবিত্র কোরআনে বর্ণিত মশা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা অবিশ্বাসী তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল? এ দ্বারা আল্লাহ তাআলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কাউকেও বিপথগামী করেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৬) ডেঙ্গু থেকে বাঁচার দোয়া
বিজ্ঞাপন
ক্ষুদ্র প্রাণী মশা কি আসলেই ব্যতিক্রম কোনো জীব, যার কারণে আল্লাহ তাআলা মশার উদ্ধৃতি পবিত্র কোরআনে তুলে ধরলেন? উল্লেখিত আয়াতে তিনটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যা ইতোমধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। যথা- ১. গঠনগত কারণে মশার সৃষ্টি অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে ভিন্ন, এমনকি অন্যান্য উড়ন্ত পতঙ্গ থেকেও অনেকগুলো কারণে ব্যতিক্রম; ২. কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ ‘বাউদাহ’ মূলত স্ত্রীবাচক শব্দ। যা নারী মশাকে বোঝায় এবং আধুনিক বিজ্ঞান ইতোমধ্যে এটি প্রমাণ করেছে যে, শুধুমাত্র স্ত্রী মশাই মানুষের রক্ত খায়। রক্ত খায় তারা তাদের ডিমে নিউট্রিশনের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য ৩. মশার চেয়েও ভিন্ন পতঙ্গ রয়েছে যারা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের থেকে রক্ত খায়।
অত্যন্ত আশ্চর্যের যে, ১৯২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানী এফডব্লিউ এডওয়ার্ডস তার গবেষণাপত্রে দাবি করেন দক্ষিণ এশিয়ার মালয় অঞ্চলে এমন এক ধরনের পতঙ্গ পাওয়া গেছে যা মশা থেকেই রক্ত খায়। এ প্রাণীটির নাম দিয়েছেন, কুলিকোইডস এনোফিলিস।
মশার কথা আল্লাহ কেন কোরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদেরকে সহায়তা করেছে। তথ্যগুলো সত্যিই সচেতন যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দেবে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ১. প্রায় দুই হাজার ৭০০ প্রজাতির মশা রয়েছে; ২. মশার এক শ’র ও বেশি চোখ রয়েছে; ৩. মশার মুখে ৪৮টা দাঁত রয়েছে; ৪. একটি মশার তিনটি পূর্ণ হার্ট (হৃদযন্ত্র) রয়েছে; ৫. মশার নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছুরির পৃথক ব্যবহার তারা করে থাকে; ৬. মশার শরীরে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন আছে, যা রাতের আঁধারে মানুষের চামড়াকে শনাক্ত করার কাজে লাগায়; ০৭. প্রত্যেক মশার নিজস্বভাবে এনেস্থেশিয়া দেয়ার জন্য এক ধরনের ভ্যাকসিন আছে, যা মানুষের শরীরে তাদের হুল ফোটানোর মাধ্যমে রক্ত নেয়ার সময় ব্যবহার করে সেই জায়গাটাকে অবশ করে নেয় যাতে রক্ত নিলেও কোনো ব্যথা পাই না আমরা, ৮. রক্ত পরীক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা এদের আছে। কারণ, এরা সব ধরনের রক্ত পছন্দ করে না; ৯. পূর্ণিমার সময়ে মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়; ১০. মশা উড়ার সময় সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তাদের পাখা নাড়ায়; ১১. বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্য সকল প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী, (১২) ১৮ ফুট দূর থেকে তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারে, ১৩. পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশি দিন বাঁচে এবং (১৪) মশার মতো আরো একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ আছে, যা মশা থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞান মশা সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের দিয়েছে তবুও আমরা বলব, আরো অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। কার্যকরী উপায় বের হওয়ার আগেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে শক্তিমান এ মানব জাতির অনেককেই। তাই, ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান হয়তো সেগুলোকেও আমাদেরকে জানিয়ে দেবে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও আমরা জানি, পৃথিবীর অহংকারী ক্ষমতাধর নমরুদ হেরে গিয়েছিল মশার ক্ষমতার কাছে। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ের রাজার নাম ছিল নমরুদ। সে নিজেকে এতটাই উচ্চতায় ভাবত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবেও দাবি করেছিল। জন্ম, মৃত্যু, খাদ্যের জোগান সব কিছু তার ক্ষমতার মধ্যে বলেও দাবি করেছিল। তার সঙ্গে নবী ইবরাহিম (আ.)-এর একটি কথোপকথন আল্লাহ তাআলা কোরআনে উল্লেখ করেছেন। (দেখুন সুরা বাকারা: ২৫৮)। এই নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এই মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে। শেষপর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবি করা এই পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে। কোরআনের এ উদ্ধৃতিটি আমাদেরকে স্মরণ করে দেয় মশার ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন আমাদেরকে পরীক্ষা করার নিমিত্তে হতে পারে, তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
উপরে উল্লেখিত কোরআনের আয়াতে সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ১. মশা সৃষ্টির মধ্যেও মানুষের জন্য আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে; ২. মশার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্টি রয়েছে; ৩. বিশ্বাসীরাই কোরআনে বর্ণিত বিষয়সমূহে সত্য সঠিক হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন করে; ৪. অবিশ্বাসীরা কোনো কিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে পারে না; ৫. এ রকম নিদর্শনও মানুষের জন্য সঠিক পথের দিশা হতে পারে; ৬. আবার অনেককে বিপথগামী করতে পারে এবং ৭. অসৎ ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ কখনও সঠিক পথে নেন না। মশার কামড় থেকে বাঁচার দোয়া
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষ করলেও আমরা আশ্চর্য হব এটা জেনে যে, কোরআন যে তথ্য প্রায় চৌদ্দশ বছর পূর্বে মানবজাতিকে দিয়েছিল তা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কোরআনের বিশুদ্ধতা নয় বরং কোরআন যে একটি জীবন্ত মুজেজা তাও বিবেচিত হচ্ছে।
হঠাৎ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং ইতোমধ্যে কিছু প্রাণহানি কিন্তু আমাদেরকে অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। অন্যান্য কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত খুবই প্রয়োজন এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য। আমাদের প্রত্যেকের উচিত সৃষ্টিকর্তা যার ক্ষমতা শুধু অসীম নয়; বরং সব কিছুতে তার কর্তৃত্ব সমাসীন, চিরস্থায়ী তার কাছেই জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা প্রয়োজন।
প্রিয়নবী (স.) একটি দোয়া আমাদেরকে শিখিয়েছেন- أعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ ‘আউযু বি কালিমা-তিল্লাহি তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক।’ অর্থ- আল্লাহর পূর্ণ কালিমার বিনিময়ে তার সৃষ্টির সব অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি। (আবু দাউদ: ৩৮৯৮)। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন। আমিন।