দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর বর্ষার আগে ও পরে রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। যা জুন-জুলাই মাসে এসে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ৮ জুলাই সারাদেশে এডিস মশাবাহিত এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন দুই হাজার ৫০২ জন। যার মধ্যে ৪৩৬ জন শুধুমাত্র রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, যা দেশের মোট রোগীর প্রায় ১৮ শতাংশ।
মাত্র ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে নিয়মিত রোগীর বাইরে এত সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তিনটি ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ডের মাধ্যমে এসব রোগীকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, তিনটি ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। এর বাইরে আরও অসংখ্য রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন যাদের স্থান হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে। অনেকের স্থান হয়েছে বারান্দায়। তবে এত কিছুর মধ্যেও চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট রোগীরা। সিট না পেলেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
তেমনই একজন মানিকনগরের চম্পা। তিনদিন আগে মুগদা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া এই নারী হাসপাতালের করিডোরে একটি শয্যা পেয়েছেন। হাসপাতালে সেবার মান ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে চম্পার মা সালেহা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, তিনদিন ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। এখন আলহামদুলিল্লাহ সে অনেকটা সুস্থ। সাতদিন ধরে তার জ্বর। তিনদিন আগে শরীর বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য বলেছে। এখানে আসার পর ভালোই সেবা পাচ্ছি। নার্সরা নিয়মিত ওষুধ দিচ্ছে। ডাক্তাররা প্রতিদিন সকালে একবার করে এসে দেখে যায়। এছাড়া তিন বেলা খাবার দিচ্ছে। খাবারের মানও মোটামুটি ভালো।
তবে প্রত্যেক রোগীকে বাধ্যতামূলকভাবে মশারি দেওয়ার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা না পাওয়ার অভিযোগ করেন সালেহা বেগম।
ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতে অবস্থান করা পঞ্চাশোর্ধ আমেনা বেগমের ছেলে ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার মায়ের আট দিন আগে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। আর হাসপাতালে এসেছি আজ দুই দিন। এর আগে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। তবে ভালো না হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এসে দেখি হাসপাতালে অনেক রোগী, কোনো বেড খালি নাই। বাধ্য হয়েই মেঝেতে রেখে মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছি।
বিজ্ঞাপন
সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নার্সরা ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে। স্যালাইন ঠিকঠাক চলছে কিনা দেখে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর হাসপাতালে এসেছি। এর মধ্যে আজ সকালে একবার ডাক্তার এসে দেখে গেছে। এছাড়া খাবার-দাবার ঠিকমতো দিচ্ছে।
ভর্তি রোগী ও সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে (৮ জুলাই) ৪৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১১১ জন। আটজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি রয়েছে। তাদের অবস্থা ক্রিটিক্যাল।
শয্যা সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, শয্যা সংকট থাকাটা স্বাভাবিক। মুগদা মেডিকেল ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। এর বিপরীতে বর্তমানে ১০৪৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। নিয়মিত ওয়ার্ডে সাধারণ রোগীরা রয়েছে। আর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য তিনটি বিশেষায়িত ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে আমরা প্রথমে বেড দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যখন তাতে হচ্ছে না, তখন আমরা রোগীদের ম্যাট্রেসের ব্যবস্থা করছি। রোগী যদি আরও বাড়ে আমাকে সেই কাজটি করতে হবে। এটি একটি বিশেষ ও সাময়িক অবস্থা, একটা সময় তা কেটে যাবে।
মশারি ব্যবহারে অনীহা এবং না পাওয়ার অভিযোগ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক রোগীকে মশারি সরবরাহ করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেঝেতে অবস্থান করা কোনো রোগীকে মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে তারা বলেন, শুনেছি মশারি দেয়। কিন্তু আমরা কেউ মশারি পাইনি। আশপাশের রোগীদের জিজ্ঞেস করে দেখেন তাদের কাউকেই মশারি দেওয়া হয়নি।
এদিকে ওয়ার্ডের রোগীদের মধ্যে যারা মশারি পেয়েছেন তাদেরও মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। বরং প্রতিটি শয্যার পাশেই মশারি ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। মশারি না ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে বেশিরভাগ রোগী গরমের কথা জানান। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, তারা মশারি ব্যবহার করেন, এখন খুলে রেখেছেন।
এমন একজন রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম। তিনদিন ধরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাকে আরও দুইজনের সাথে বিছানায় বসা অবস্থায় দেখা যায়। রোগীদের সার্বক্ষণিক মশারির নিচে থাকার কথা হলেও তাদের জন্য বরাদ্দ মশারিটি বিছানার পাশে স্ট্যান্ডে ঝুলে ছিল। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবসময় মশারির নিচেই থাকি। রোগী বেশি থাকায় আশপাশে বসার জায়গা নেই। তাই মশারি খুলে সবাই একসাথে খাবার খেয়েছি। এখন আবার টানিয়ে ফেলব।
মশারি না পাওয়া এবং ব্যবহার না করার বিষয়ে কর্তব্যরত নার্সের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব রোগীর জন্যই মশারি আছে। কিন্তু কিছু স্ট্যান্ড কম থাকায় সবাইকে দেওয়া যায়নি। বিশেষ করে যারা মেঝেতে থাকছে তাদের স্ট্যান্ড ছাড়া মশারি দিলে টানাবে কোথায়? আবার যাদের দেওয়া হয়েছে তারাও ব্যবহার করে না। গরমের কথা বলে তারা মশারি টানাতে চায় না। ফলে যারা পায়নি তারাও মশারি নিতে ইচ্ছুক না।
মশারি ব্যবহার করতে রোগীদের বলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বারবার রোগীদের মশারির নিচে থাকতে বলি। কিন্তু তারা থাকতে চান না, বলেন গরম লাগে। তারা ব্যবহার না করলে আমাদের কি করার আছে। জোর করে তো মশারি টানিয়ে দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে হাসপাতালে পরিচালক রোগীদের অনীহার কথা স্বীকার করলেও মশারি ও আনুষাঙ্গিক অন্যান্য জিনিসের ঘাটতি থাকার কথা অস্বীকার করেন। হাসপাতাল পরিচালক বলেন, পর্যাপ্ত মশারি ও আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র আমাদের কাছে রয়েছে। যারা মশারি পায়নি, তাদের মশারি দিতে চেয়েছি। কিন্তু তারা গরমে কথা বলে নিতে চায়নি।
মশারি ব্যবহার না করা প্রসঙ্গে তিনি ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, মশারি টানানোর বিষয়ে আমরা রোগীদের প্রতিনিয়ত কাউন্সিলিং করছি। তাদের বারবার মশারি ব্যবহার করার জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা বলছেন। কিন্তু গরমের কথা বলে তারা তা ব্যবহার করছে না। এখন কেউ যদি মশারি না টানায়, আমরা তাদের বুঝাতে পারি। জোরপূর্বক মশারি টানিয়ে দিতে পারি না।
এমএইচ