শুধু বর্ষা নয়, সব মৌসুমেই এখন ডেঙ্গু হচ্ছে। এবার বর্ষার শুরুতেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গুকে মহামারি উল্লেখ করে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠনের তাগিদ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। একই সাথে এবারের পরিস্থিতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ঢাকা মেইলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। এ সময় বিভিন্ন ভবনের জরিমানা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১২ হাজার ৯৫৪ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১০ হাজার ১৩১ জন। আর চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৩ জন। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৭৫০ জন ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ৯৬৮ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরে ৭৮২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।
ডেঙ্গুর পুরো মৌসুম শুরু হবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। অথচ এর আগেই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ। শয্যার অভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেঝেতে রেখেই দিতে হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত একমাসে কয়েকগুণ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রোগী ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। এখন নির্দিষ্ট মৌসুম নেই। আমরা সারাবছরই রোগী পাই। শহর গ্রাম নির্বিশেষে সবখানে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণত জুনের পর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তাই আগামী দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটা টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। এটা জরুরিভিত্তিতে করা দরকার। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অন্তত ৫ বছরের জন্য পরিকল্পনা নেয়া দরকার।
সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের প্রস্তুতি বলতে স্বাস্থ্য বিভাগ আর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা হয়তো ভেবেছে গত বছর বেশি হয়েছে, এ বছর কম হবে। ডেঙ্গুকে অন্যান্য রোগের মতো গতানুগতিকভাবে চিন্তা করেছে। ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি সিটি কর্পোরেশন আর স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে দরকার। ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণের একটি নির্দেশিকা করেছে। সেটি মনে হয় কাগজেই পড়ে আছে। খুবই সুন্দর ছিল নির্দেশিকা। কি কি কাজ হবে, কারা কিভাবে করবে— সব আছে ওই নির্দেশিকায়। এটি কার্যকর করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স লাগবে। জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবার এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গু তো মহামারি হয়ে গেছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে যদি সার্বিকভাবে এগিয়ে না আসা হয় তাহলে মানুষ মরতেই থাকবে। এটি যে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি বা মহামারি— সেটির স্বীকৃতিই তো নাই। এটাকে গতানুগতিক হিসেবে দেখছে। স্বাস্থ্য বিভাগ উপদেশ দেয় সিটি কর্পোরশনকে, সিটি কর্পোরেশন উপদেশ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগকে। এটি কোনো কথা হলো? একই সরকার, একই দেশ, একই সমস্যা। এটা ঠিক না। দুই মন্ত্রণালয় সমন্বয় করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বা কোনো একজন সিনিয়র মন্ত্রীর নেতৃত্বে এই টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ করা প্রয়োজন বলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের দেশে এখন চার ধরনের ডেঙ্গু পাওয়া যাচ্ছে— ‘ডেন-১’, ‘ডেন-২’, ‘ডেন-৩’ ও ‘ডেন-৪’। এ বছর ‘ডেন-২’ ও ‘ডেন-৪’-এ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এরমধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ‘ডেন-২’-তে।
তিনি বলেন, কেউ যেকোনো একটি ধরনে আক্রান্ত হলে তার শরীরে ওই ধরনের ডেঙ্গুর প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তিনি আর সেই ধরন দ্বারা আক্রান্ত হন না। তবে অন্য যেকোনো একটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে প্রথমবার আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি যদি দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুর নতুন ধরন দিয়ে যদি আক্রান্ত হন তাহলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা দুটোই বাড়ে। ভারতে ‘ডেন-৫’ শনাক্ত হয়েছে, তবে বেশি ছড়ায়নি এখনও। এটি শেষ পর্যন্ত আমাদের এখানেও আসবে।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ে রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বর্ষা মৌসুম ছাড়াও আমরা ডেঙ্গু দেখছি। শীতকালেও এমন কোনো দিন নাই যে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। এর প্রধান কারণ জলবায়ুগত। শীতের সময় যে তাপমাত্রা ছিল বাতাসে, যে আর্দ্রতা ছিল এতে মশার প্রজনন বন্ধ হয় নাই। এখন যদি সমন্বিত চেষ্টা না করি, এটি সব মৌসুমের জন্যই করতে হবে। এটি স্বাস্থ্য বিভাগকে করতে হবে। প্রচুর সংখ্যক জনস্বাস্থ্য কীটতত্ববিদ দরকার। এটি রাতারাতি হবে না। ভলান্টিয়ার যারা পাড়া-মহল্লায় কাজ করবে তাদের দুদিনের ট্রেনিং দিয়ে কাজে লাগানো যায়। ডেঙ্গু শনাক্ত হলে মানুষ যেন দ্রুত চিকিৎসার আওতায় যায়— এমন উদ্যোগ দরকার।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনায় এখন প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র করা দরকার, যেখানে সরকারিভাবে কোভিডের মতো তাৎক্ষণিক ডেঙ্গু পরীক্ষা ব্যবস্থা থাকবে। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে বাড়ি না পাঠিয়ে বিছানা করে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। দেখভালে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স-ভলান্টিয়ার থাকবে। রোগের কোনো লক্ষণ দেখলে হাসপাতালে নিয়ে আসবে— এই ট্রেনিং দিয়ে ভলান্টিয়ারদের কাজে লাগানো যাবে।
সব রোগী যদি হাসপাতালে যায় তাহলে কত ডাক্তার লাগবে— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সব রোগী যদি মুগদা, ঢাকা মেডিকেল বা মিডফোর্ডে যায় তাহলেও চিকিৎসায় চাপ বাড়ে। রোগী বাছাই করতে হবে ওয়ার্ড পর্যায়ে। যারা গুরুতর তাদেরই পাঠাতে হবে হাসপাতালে। আর যাদের ওখানে (ওয়ার্ড পর্যায়ে) রেখেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব তাদের হয় বাসায় মশারির ব্যবস্থা করবেন, নয়তো ওইস্থানেই কমিউনিটি কেন্দ্রে মশারির ব্যবস্থা করবেন। পর্যবেক্ষণের জন্য হাসপাতালে একটা কেন্দ্র রাখতে হবে যারা বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী নারী গুরুতর নয় অথচ যেকোনো সময় গুরুতর হতে পারে তাদের জন্য। এই তিন ভাগে ভাগ করে স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, আরেকটা অবজারভেশন, আরেকটা গুরুতর রোগীর জন্য।
ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে লার্ভা খোঁজা এবং জরিমানা করা নিয়ে তিনি বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা। জরিমানা সিস্টেমটা খুবই খারাপ, খুবই ক্ষতিকর। নাগরিকদের মধ্যে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। নাগরিকরা প্রশিক্ষিত না। সুতরাং সে কি করে জানবে কোথায় পানি জমে আছে, মশা ব্রিডিং করছে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভলান্টিয়াররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এটা দেখাবে, শেখাবে। জরিমানা করলে সে আপনাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। জনস্বাস্থ্য কীটতত্ববিদরা এটা দেখাবে, শেখাবে।
ডা. মুশতাক হোসেন প্রশ্ন রাখেন, ম্যাজিস্ট্রেটরা হাসপাতালের ছাদে গিয়ে লার্ভা পরীক্ষা করে না কেন? স্বাস্থ্যের ডিজি অফিসের ছাদে পরীক্ষা করে না কেন? থানা প্রাঙ্গণে জব্দ করা গাড়ি পড়ে আছে, সেখানে পানি জমে আছে, সেখানে পরীক্ষা করে জরিমানা করছে না কেন? ভালো কাজ বাড়ানো উচিৎ।
কে বুদ্ধি দিয়েছে এই জরিমানা করার— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের সমস্যা কখনো জরিমানা করে, লাঠিপেটা করে সমাধান হয় না। এটা জনগণকে সম্পৃক্ত করেই করতে হয়। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন চেক করা উচিৎ মশার প্রজনন ক্ষেত্র আছে কিনা, রোগী, ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে আক্তান্ত না হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস মশাবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে যায়। সে বছর দেশে ৫ হাজার ৫৫১ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল—এই চার বছর এবং ২০১৪ সালে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি।
২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এরপর দেশের সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় গত বছর (২০২২)। আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা যান ২৮১ জন। এটি ছিল দেশে যেকোনো বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
ডব্লিউএইচ