দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি রোগী দেখা গেছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে। বিত্তশালীরা বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের একমাত্র আশ্রয়স্থল সরকারি হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও আনুসাঙ্গিক খরচ ও ডেঙ্গু পরবর্তী জটিলতায় চাপ পড়ছে নিম্নবিত্তদের খরচে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর শারীরিক দুর্বলতার কারণে অনেককেই বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকা লাগছে। এই সময় আয়-রোজগার বন্ধ ধাকায় এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয় ফ্রি করে দিলে চাপ কমবে নিম্নবিত্তদের।
শনিবার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে রোগীদের উপচেপড় ভিড়। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বেডের পাশাপাশি ফ্লোরেও রোগী। সিড়ির গোড়া থেকে শুরু করে লিফটের সামনে পর্যন্ত রোগীর বেড দেখা গেছে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৪৫ জন। এর মধ্যে ৪৩৬ জন ভর্তি ছিল ডেঙ্গু রোগী। যেখানে সারাদেশেই হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা আড়াই হাজার সেখানে এই হাসপাতালেই রোগীর সংখ্যা প্রায ৫০০। দিন দিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সরা বলছেন, সেবা দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
যাত্রাবাড়ী থেকে আসা এক রোগীর স্বজন আনিসা বেগম বলেন, আমার ভাই ভর্তি আছে। তিন-চারদিন আগে জ্বর হলে ডেঙ্গু টেস্ট করাই। ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ভর্তি করার পর বেড পাই নাই। তাই ফ্লোরেই আছি। তিনি আরও বলেন, ডাক্তার তরল জিনিস খাওয়াতে বলছে। নিচে একটা ডাবের দাম ১০০-১২০ টাকা। দিনে ৪-৫টা ডাব কিনতে ৫০০ টাকার উপরে লাগতেছে। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে খরচ হচ্ছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মানিকনগর থেকে আসার সালেউর বলেন, নিচতলায় ভাড়া থাকতাম। তাই বাসায় প্রচুর মশা ছিল। আমাদের এলাকাতেও অনেক মশা। দুদিন আগে রোগী ভর্তি করাইছি। ওষুধপত্র এখান থেকেই দিচ্ছে। কিন্তু কিছু টেস্ট যেগুলা এখানে করালে পরের দিন রিপোর্ট দিচ্ছে, তাই বাইরে থেকে করাচ্ছি। বাইরে করালে ওইদিনই রিপোর্ট পাওয়া যায়। বাইরে টেস্ট করালে খরচ অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য খরচ, যাতায়াত, খাবার কিনতে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। এমনি ঈদের পরে হাত খালি। খরচ করতে করতে অবস্থা খারাপ।
জানা গেছে, মুগদা মেডিকেলে ডেঙ্গুর এনএস-১ টেস্ট করাতে খরচ হচ্ছে ১০০ টাকা, সিবিসি করতে খরচ ১৫০ টাকা। এছাড়া এই হাসপাতালে সিঙ্গেল কেবিন খরচ প্রতিদিন ৫৭৫ টাকা। ডাবল কেবিন (২ রোগীর) ৪৭৫ টাকা। অধিকাংশ ঔষধ ও স্যালাইন হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হয়। রোগীর অবস্থার ওপর খরচ কমবেশি হয়। কাউকে ব্লাড দিতে হলে খরচ আরও বেড়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
এদিকে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি। বেসরকারি হাসপাতলে সাধারণ অবস্থায় একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকার সিবিসি টেস্ট, ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড ভাড়া ও ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। রোগীর পরিস্থিতির অবনতি হলে এ খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া শফিকুল বলেন, আমি প্রথমে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়েছি কিন্তু অবস্থা খারাপ হলে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হই। ভর্তির সময় ডেঙ্গুর এনএস-১ পরীক্ষা এবং রক্তের সিবিসি টেস্টসহ ৫টি পরীক্ষা দেওয়া হয়। তাতে প্রথমেই প্রায় দেড়-দুই হাজার টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া স্যালাইন-ক্যানোলাসহ বেশকিছু ঔষধ কিনতে ২ হাজার টাকা লেগেছে। প্রথম দিনেই ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর হাসপাতালে থাকা, খাওয়া-দাওয়া-ওষুধপত্র ডাক্তার ফি— সব মিলে ৪ দিনে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি জানান, আমি গরিব মানুষ। ওষুধপত্রসহ সবকিছুরই দাম বাড়তি। বাসা ভাড়া দেওয়ার পর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসক আরও প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছে। কিভাবে ওষুধ কিনব আর কিভাবে সংসার চালাব কিছুই মাথায় আসছে না।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় খরচের বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা তথ্য বলছে, একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিকিৎসায় খরচ করতে হয় ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর বেসরকারি হাসপাতালে রোগীপ্রতি গড় খরচ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা। চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল ইত্যাদি, সম্মিলিত ব্যয়কে একজন রোগীর মোট খরচ হিসাবে দেখানো হয়েছিল ওই গবেষণায়। তাতে দেখা গেছে, এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের রোগীপ্রতি ৬ হাজার ৭৬ টাকা খরচ হয়। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের মোট আয়ের ১৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় করেছিল। সংশ্লিষ্ট পরিবার তাদের সঞ্চয়, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ বা সম্পদ বিক্রি করে এ ব্যয়ের অর্থ জোগান দিয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারি সহাসপাতালে সকলপ্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যেসহ বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে ডেঙ্গু চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকা শহরে নিম্নবিত্তরাই বেশি ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে যারা নিচতলায় ভাড়া থাকেন, বস্তি এলাকার মানুষ তাদের বেশি ডেঙ্গু রোগ হচ্ছে। এখন বর্ষাকালে অনেক এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যাচ্ছে। এতে মশার বিস্তার ঘটছে। এজন্য সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফ্রি করার দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খুব কম খরচে এই রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা দাবি জানাচ্ছি।
টিএই