রাজধানীর পশ্চিম কাজীপাড়ার বাসিন্দা সাইফুদ্দিন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই ব্যক্তি গত কয়েকদিন টানা উচ্চ জ্বর ও শরীর ব্যথায় ভুগছিলেন। গত ১ জুলাই অফিসে থাকাকালীন তার প্রচণ্ড শরীর ব্যথা এবং হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। সতর্কতা হিসেবে তিনি দ্রুত মিরপুর-১০ এর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পরমর্শ নেন। চিকিৎসক তাকে ডেঙ্গুসহ বেশকিছু পরীক্ষার পরামর্শ দেন। পরীক্ষায় তার দেহে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং প্লটিলেট ১১ হাজার বলে জানা যায়। তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন।
ভর্তির পর তার প্লাটিলেট কমে ৩ হাজার এবং সর্বশেষ এক হাজারে নেমে আসে। আতঙ্কিত সাইফ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কথা জানিয়ে রক্তের জন্য পোস্ট করেন। সহকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য তিনজন ডোনারও ব্যবস্থা করা হয়। তবে চিকিৎসকরা সায় না দেওয়ায় প্লাটিলেট গ্রহণ করেননি তিনি। যদিও পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই তার প্লাটিলেট বাড়তে থাকে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি হাসপাতাল ছাড়েন।
বিজ্ঞাপন
সাইফুদ্দিনের মতো সারাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নাম প্লাটিলেট কমে যাওয়া। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রক্ত চেয়ে করা বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে স্পষ্ট। একইসঙ্গে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের প্লাটিলেট চেয়ে মানুষের আবেদন থেকেও এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। রোগীরা ডেঙ্গু ধরা পরার পর থেকেই ডোনার খোঁজতে থাকেন এবং একাধিক ডোনার প্রস্তুত রাখেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্লাড সেন্টারের মেডিকেল অফিসার ডা. জাহিদুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, ডেঙ্গু বাড়ার সাথে সাথে প্লাটিলেটের চাহিদা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে। আমরাও নিয়মিত রোগীর স্বজনদের থেকে প্লাটিলেটের চাহিদা পাচ্ছি। তবে আমরা নিজেরা প্লাটিলেট সংরক্ষণ করি না। কেননা প্লাটিলেট রক্ত বা প্লাজমার মতো দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। এর জীবনকাল মাত্র পাঁচ দিন। এবং সেটিও অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় ফ্রিজারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হয়। আমরা প্রসেসিং করে রাখলাম কিন্তু রোগী এলো না, সেক্ষেত্রে প্লাটিলেট নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই আমরা নিজেরা সরাসরি প্লাটিলেট সাপ্লাই করি না। তবে রোগী যদি ডোনার সাথে করে নিয়ে আসে সে ক্ষেত্রে আমরা প্রসেসিং করে দেই। যা প্রায় সব ব্লাড সেন্টারেই করা হচ্ছে।
তবে ডেঙ্গু রোগীদের প্লটিলেট আতঙ্ক নিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন ভিন্ন কথা। চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কত তা ঘনঘন না দেখে বরং রোগীর অন্যান্য বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিত। যেমন রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা, রোগী পানি শূন্যতায় ভুগছে কিনা, রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট কেমন তা পরীক্ষা উচিত। বিশেষ করে পিসিভি নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। কেননা ডেঙ্গুতে সবথেকে বেশি মৃত্যু ঝুঁকি থাকে শক সিনড্রোমে। এতে রোগীর মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউরের সম্ভাবনা থাকে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ। এমনকি রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও শক সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি নানা শারীরিক জটিলতায় ভোগেন। এ বাস্তবতায় প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তা না করে বরং রোগী যেন শক সিনড্রোমে চলে না যায় সেদিকে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
বিজ্ঞাপন
প্লাটিলেট নয়, শক সিনড্রোমে গুরুত্বের তাগিদ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ শাখার সাবেক পরিচালক ও প্রখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, শক সিনড্রোমে চলে যাওয়া রোগীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক। এটি নির্ণয়ের জন্য একটি পরীক্ষা রয়েছে, যার নাম পিসিভি বা প্যাক্ট সেল ভলিউম। রোগীদের এটা আবশ্যিকভাবে করা দরকার। কারো যদি পেক্ট সেল ভলিউম বেড়ে যায় তাহলে সেই রোগীর শকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তপাত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা নেই বললেই চলে। কিন্তু প্যাক্ট সেল ভলিউম বেড়ে যাওয়া মানে রক্ত থেকে তরল অংশটুকু বেরিয়ে গেছে। তখনই রোগী শকে চলে যায়। তাই এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, প্লাটিলেট নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে শক সিনড্রোম নিয়ে। এর কারণে রোগীরা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) যাচ্ছে। রোগী মৃত্যুর কারণও এই শক সিনড্রোম। রোগীদের বুঝতে হবে প্লাটিলেট দিলেই জাদুর মতো কোনো কাজ হবে না। বরং প্লটিলেটের মাধ্যমে ভাইরাস পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিকভাবে স্ক্রিনিং না করা হলে প্লাটিলেটের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি এমনকি এইচআইভি হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। রোগীদের উচিত প্লটিলেট নিয়ে চিন্তা না করে চিকিৎসকের উপর নির্ভরশীল হওয়া। প্রয়োজন বোধ করলে চিকিৎসকরাই তাদের পরামর্শ দেবেন। এ নিয়ে চিন্তা করা রোগীর জন্য অহেতুক। বরং এই দুশ্চিন্তা অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শক সিনড্রোমে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ও মৃত্যু
শক সিনড্রোমের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, শক সিনড্রোম একজন মানুষের দেহে সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় রোগীর মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউর দেখা দেয়। তার কিডনি, লিভার ফেইলিউর হয়, তার ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড কাজ করে না। ফলে রোগী কোমায় চলে যায়। এ অবস্থায় অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। শক সিনড্রোম ডেঙ্গু রোগীদের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা। এক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়ে গেলে বেশিরভাগ সময় সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে যায়। তবে কারো যদি আগে থেকেই অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত থাকে তাহলে তা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হতে পারে।
এমএইচ