শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

জায়েদার বাজিমাত ও আজমতের ভরাডুবি নিয়ে সরগরম গাজীপুর

আবুল হাসান
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২৩, ০৫:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

জায়েদার বাজিমাত ও আজমতের ভরাডুবি নিয়ে সরগরম গাজীপুর

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ের হাসি হেসেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। হেভিওয়েট প্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করে নগর ভবনের চাবি পেলেন তিনি। ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তি ইমেজ ও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই তার বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা। হামলা ও নেতাকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ থাকলেও জায়েদা খাতুন বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি সবার সহযোগিতার কারণে তিনি ভোটের মাঠে জয়ী হয়েছেন।

ভোটার ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লা খান। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে জড়িত। ছাত্রলীগ নেতা থেকে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মহানগর গঠন করা হলে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টঙ্গীর পৌরসভায় ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করলেও এরপর কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি আজমত উল্লা। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১৮ সালে দলীয় পদ নৌকা চাইলেও নৌকার কান্ডারি হন জাহাঙ্গীর আলম। বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম।


বিজ্ঞাপন


এরপর তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর এক বিতর্কিত ভিডিও ভাইরাল হলে মেয়র ও দলীয় পদ হারান জাহাঙ্গীর আলম। ২০২৩ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা জায়েদা খাতুন। ঋণখেলাপির দায়ে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল করা হলেও ছেলের কৌশলে শেষ পর্যন্ত মাঠে তৎপর ছিলেন মা জায়েদা খাতুন। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ মে) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৬ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন জায়েদা খাতুন। আর এ নির্বাচনে হেরে যান হেভিওয়েট প্রার্থী আজমত উল্লা খান।

22

গতকাল উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে। নানামুখী চাপ সত্ত্বেও ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম নারী মেয়র হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের হাল ধরতে যাচ্ছেন তিনি। স্থানীয়রা বলছেন, ছেলের হাত থেকে নগরীর চাবি নিলেন মা জায়েদা। গতকাল ভোটের ফলাফল পাওয়ার পর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন উপস্থিত নেতাকর্মীরা। মুহুর্মুহু ঘড়ি ঘড়ি শ্লোগান দিয়ে আনন্দে আত্মহারা যেন প্রত্যেকটি নেতাকর্মী।

শুক্রবার (২৬ মে) ভোরের আলো ফোটার পরেই জায়েদা খাতুনের নিজ বাড়ি ছয়দানা এলাকায় মানুষের ঢল নামে। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ জড়ো হন তার বাসভবনে। এসময় অনেকের হাতে ছিল ফুলের মালা, অনেকেই নিয়ে আসেন মিষ্টি।


বিজ্ঞাপন


উপস্থিত নেতাকর্মীরা মিষ্টি মুখ করে তাদের বিজয় উদযাপন করেন। এর আগে শুক্রবার ভোরে গণমাধ্যম কথা বলেন নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন। তিনি বলেন, গাজীপুরবাসীর সবাইকে শুভেচ্ছা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও শুভেচ্ছা। আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানাই। ভোটটা আমার সুষ্ঠু হয়েছে। আমি আমার ভোটের হিসাব পেয়েছি। এ সময় তার পাশে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।

সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জায়েদা খাতুন বলেন, এই বিজয় আমি গাজীপুরবাসীকে দেব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেব। গাজীপুরবাসীর ঋণ আমি শোধ করার চেষ্টা করব। সাংবাদিকরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাই আপনাদের ঋণও আমি শোধ করব। আপনারা যখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তখন আমার সাথে বা আশেপাশে কেউ ছিল না। আমি গাজীপুরের কাজ করেই ঋণ শোধ করব। কাজটা যেহেতু আমি একা করতে পারব না, তাই আমার ছেলেকে নিয়ে করব, যে আগে থেকেই আমার পাশে ছিল।

নতুন মেয়র বলেন, ‘আমি আজমত উল্লাহ খানকে জিজ্ঞেস করে ও মতামত নিয়েই কাজ করব। একজনের জায়গা দিয়ে রাস্তা যাবে, একজনের জায়গা দিয়ে ড্রেন যাবে, কিন্তু দিতে চাইবে না। তাই সবাইকে সাথে নিয়েই কাজ করব। ছেলের ওপর মিথ্যা অভিযোগ তোলার দুঃখে এবং মিথ্যার প্রতিবাদে আমার ভোটে আসা। গাজীপুরের মানুষকে এত ভালোবাসছি, এবার দেখি তারা আমারে কেমন ভালোবাসে? এই ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্যই ভোটে আসা। আমি গাজীপুরবাসীর ভালোবাসা পেয়েছি।

00

এ সময় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখন আমি মেয়র নই, কিন্তু আমার মা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সেই হিসেবে এই শহরের যত কাজ আছে আমি মায়ের সঙ্গে থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কাজগুলো করব। আজমত উল্লাহ খান আমার বড় ভাই। তার পরামর্শ এবং এখানে বড় যারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আছে সবার সঙ্গে আলোচনা করে, পরামর্শ নিয়ে আধুনিক শহর গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এই শহরবাসী আমাদের বিশ্বাস করেছে। বড় মানুষরা ছিল না, কিন্তু এই শহরের খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের পাশে থেকে মাকে, আমাকে সহযোগিতা করেছে। তাদের জন্য আমরা ভালো কিছু করার চেষ্টা করব।

এদিকে মেয়র হিসেবে জায়েদার বিজয় ও আজমত উল্লার পরাজয় নিয়ে সরগরম চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনসমাগম এলাকা। এ নিয়ে নানামুখী হিসাব-নিকাশ করছেন ভোটাররা। তবে ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের ইমেজ ও তার উন্নয়ন কাজ নগরবাসীকে মুগ্ধ করেছে। আর এর প্রতিদান যেন ভোটের মাঠে দিয়েছেন সাধারণ জনগণ।

স্থানীয়রা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘ তিন বছর এলাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ করেছেন। রাস্তাঘাটসহ এলাকার চিত্র আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এরপর তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে থমকে যায় উন্নয়ন কাজ। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নাজেহাল হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা তার ওপর অটুট থাকায় নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে মা জায়েদা খাতুনের বিজয়ে।

ছেলের ওপর অন্যায় করা হচ্ছে দাবি করে এর প্রতিকার চেয়ে জায়েদা খাতুনের বক্তব্য মানুষের ওপর এক ধরনের আবেগ সৃষ্টি করে। এছাড়া নির্বাচনের প্রচারণায় কয়েক দফা হামলা, বাধা দেওয়ার বিষয়টি মানুষের নজর কেড়েছে। আজমত উল্লা খানের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা এসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ফলে মানুষ অনেকটা বিরক্ত হয়েই আজমত উল্লা খানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

33

এছাড়া আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল আজমত উল্লা খানের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের পর তার অনুসারীদের নানাভাবে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। এসময় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে শোকজ নোটিশ দেয় মহানগর আওয়ামী লীগ। ফলে জাহাঙ্গীর অনুসারীরা পড়েন বেকায়দায়। এক পর্যায়ে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে বিরোধ কিছুটা কমলেও তার রেশ ছিল এই নির্বাচনে। এ নিয়ে অনেকে ফেসবুক পোস্টে লেখেন- লেবু বেশি চাপলে সেটি তেতো হয়ে যায়। এ অবস্থায় বাইরে অনেক নেতাকর্মী নৌকার ব্যাচ লাগিয়ে প্রচার চালালেও ভোটের দিন তারা জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দেন।

স্থানীয় কয়েকজন ভোটার বলেছেন, আজমত উল্লা তিন মেয়াদে টঙ্গী পৌরসভার মেয়র থাকলেও এলাকায় তিনি তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ করেননি। এছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার তেমন উঠাবসা নেই। ফলে সাধারণ মানুষ তাকে আস্থায় নিতে পারেনি। অপরদিকে, জাহাঙ্গীর আলমের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট নেই। তাই তার মাকে জয়ী করতে অনেকটা একাট্টা ছিলেন সাধারণ ভোটাররা।

এছাড়া এই নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে অর্ধেক ভোটার ছিল নারী। জায়েদা খাতুন একমাত্র নারী মেয়র প্রার্থী হওয়ায় নারী ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ভোটের মাঠে এবার তার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেকে।

তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। আর পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ভোট নিয়ে নানা অপপ্রচার ছিল। কিন্তু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এসময় তিনি বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানান।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর