বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জিং বাজেট, সব মহলের উদ্বেগ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০২ জুন ২০২৫, ১০:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

saleh
নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থ উপদেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত
  • বাজেটের আকার কমলেও ‘চাপ’ কমেনি
  • বাজেট ততটা আশাব্যঞ্জক নয়: ডিসিসিআই
  • বাজেটের সাইজ ছোট হওয়া উচিত ছিল: বিএনপি
  • বাজেট অনেকটাই গতানুগতিক: জামায়াত
  • কালো টাকা সাদা করার সিদ্ধান্ত অনৈতিক: টিআইবি

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবার (২ জুন) বিকেলে এই বাজেট ঘোষণা করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ৫৪তম বাজেট এটি। বাজেটে মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়ন ও বিভিন্ন দিক নিয়ে উদ্বেগ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সব মহলেই।


বিজ্ঞাপন


এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে করছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে তারা চেষ্টা করেছেন সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে তারা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছেন জনগণকে।

উপদেষ্টা বলেন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ—এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

Saleh2


বিজ্ঞাপন


প্রস্তাবিত এই বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, জনপ্রসাশনে বরাদ্দ ১ লাখ ২১ হাজার ৬৬০ কোটি। এছাড়াও প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকা, কৃষিতে বরাদ্দ ৪৬ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে বরাদ্দ ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা।

বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগে গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই তুলনায় এবার বাজেটের আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কম।

এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জোগান দেবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ ভাগ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঘাটতির ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেটে পরিচালন ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এবার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর ৫৭ ভাগই যাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে। নতুন বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ ভাগ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে।

এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর কমতে পারে ২ দশমিক ৫ ভাগ। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর নামবে ২০ শতাংশে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে পুঁজিবাজারের বাইরের প্রতিষ্ঠানের করহার। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগের মতোই ২৭ দশমিক ৫ ভাগ কর দিতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে ব্রোকারেজ হাউজের সিকিউরিটিজ লেনদেন কর শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাজেট বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এবারের বাজেটটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তারপরেও অন্তবর্তী সরকার বেশ সাহসী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বাজেটে ঘাটতির যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে প্রকৃত ঘাটতি এর চেয়ে আরও বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কেননা অন্যান্য অর্থবছরের তুলনায় এবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণ তথা  ব্যাংক খাত থেকে খুব বেশি ঋণ সহায়তা আশা করা যাচ্ছে না। উপরন্তু কয়েকটি ব্যাংকে সরকারকেই মূলধন সহায়তা দিতে হবে। তাই বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে। সার্বিকভাবে এ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে।’

Budget44

বাজেট প্রতিক্রিয়ায় খুব একটা খুশি নন ব্যবসায়ীরাও। বাজেট বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ন্যূনতম করের সমন্বয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুমোদন যোগ্য বিয়োজনের আওতা বৃদ্ধি, করজাল সম্প্রসারণ এবং অটোমেটেড রিটার্ন ব্যবস্থা চালুর মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, সহজে ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ উন্নয়ন, সিএমএসএমই এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় সার্বিক ব্যবসা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ততটা সহায়ক নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বেশ বড়, যা অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের করের সীমা অপরিবর্তিত রাখা এবং স্ল্যাব উঠিয়ে নেওয়ায় মধ্যবিত্ত ও বিশেষকরে চাকরিজীবীদের করের বোঝা আগামী অর্থবছর হতে আরও বেশি বহন করতে হবে।

বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি। বাজেটের সাইজ ছোট হওয়া উচিত ছিল। গুণগত দিক দিয়ে এবারের বাজেটে পরিবর্তন নেই, সংখ্যার সামান্য পরিবর্তন রয়েছে। তাই সরকারের জন্য এই বাজেট বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ হবে না। তবে আগামীকাল মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বাজেটে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, পূর্বের বাজেটসমূহের ন্যায় এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের মোটা দাগে খুব একটা তফাৎ পরিলক্ষিত হয়নি। এবার বাজেটে ব্যয় না বাড়লেও তেমন কোনো ব্যয় কমেওনি, এতে কোনো নতুনত্বের ছোঁয়াও পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা ২ জুন বিকেলে টিভি চ্যানেলে ভাষণের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এক বাজেট পেশ করেছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বাজেটে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। পূর্বের বাজেটসমূহের ন্যায় এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। এই বাজেটে বড় অঙ্কের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরেও এর কাছাকাছি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে আমরা মনে করছি।

এবারের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে সরকার। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি অন্তর্বর্তী সরকারের এ উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করে বলেছে, বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর