‘টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ, চোখের সামনে স্বজনের যন্ত্রণা দেখছি। আবার কোনোভাবে টাকা জোগাড় করে চিকিৎসা করালেও বাঁচার নিশ্চয়তা নেই, আমাদের জন্য এটি মারাত্মক মানসিক কষ্ট’— বলছিলেন ক্যানসার আক্রান্ত আবুল বরকতের (ছদ্মনাম) ভাতিজা বিল্লাল হোসেন। নোয়াখালীর বাসিন্দা ৬৬ বছর বয়সী আবুল বরকত আট মাস যাবত স্টেজ-ফোর পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত। দীর্ঘ চিকিৎসার খরচে পরিবারটি বর্তমানে অনেকটাই নিঃস্ব। তবে রোগীর যন্ত্রণা অসহ্যকর উল্লেখ করে পরিবারটি তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। যদিও শেষ রক্ষা হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন আবুল বরকতের স্বজনরা।
বাংলাদেশে ক্যানসার সাধারণত দেরিতে শনাক্ত হয়, যখন রোগ ইতোমধ্যে জটিল পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফলে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে যায় এবং বাঁচার সম্ভাবনাও কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে রোগীর স্বজনদের মানসিক চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কারণ, তারা জানে প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তা করার জন্য হয় অর্থের সংকটের মুখে পড়তে হবে, নয়তো সব চেষ্টার পরও হার মানতে হবে। চিকিৎসার বিপুল ব্যয়, ঋণের বোঝা আর প্রিয়জনের যন্ত্রণার দৃশ্য একসাথে মিলে স্বজনদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। চিকিৎসা অব্যাহত রাখার চাপ আর প্রিয়জনকে হারানোর ভয় তাদের জন্য এক অসম্ভব মানসিক লড়াইয়ে পরিণত হয়।
বিজ্ঞাপন
তেমনি লড়াইয়ের গল্প উঠে আসে আবুল বরকতের ভাতিজা বিল্লাল হোসেনের মুখ থেকে। চাচার রোগ সম্পর্কে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমার চাচা দীর্ঘদিন যাবত পেট ব্যথায় ভুগছিলেন। উনি গ্রামে চিকিৎসা নিতেন। ওইখানের চিকিৎসক আলসারের ট্যাবলেট দিত। ঠিক আলসারও ধরা পড়েনি, গ্যাসট্রিক ভেবে ট্যাবলেট খেতেন। এতে পেটের ব্যথা কমে যেত। এক সময় ওষুধ খাওয়ার পরেও উনার ব্যথা যেত না। তখন আমরা ল্যাব এইড হাসপাতালে ডাক্তার দেখাই। ২০২৪ সালের মে মাসে উনার পাকস্থলীর ক্যানসার ধরা পড়ে। ক্যানসার চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা চালানো পরিবারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সেবা পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। এ অবস্থায় আমরা ইবনে সিনা হাসপাতালের অনকোলজির একজন চিকিৎসক দেখিয়ে, তার অধীনেই চিকিৎসা করাচ্ছি।
চিকিৎসক ও সেবা পাওয়ায় ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্যানসার হওয়ার পর চিকিৎসক পাওয়াতে সমস্যায় পড়েছি। কোথায় বা কার কাছে দেখাবো এটা বুঝতে পারা কষ্টকর ছিল। বাংলাদেশে টাকা যেখানে কম সেখানে সেবা পেতে ভোগান্তি, যেখানে সেবা দ্রুত পাওয়া যায় সেখানে টাকার সমস্যা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এটা খুবই কষ্টকর একটা অবস্থা। আমাদের রোগীর কষ্টও দেখা লাগে, টাকাও চলে যাচ্ছে। এদিকে এত কষ্টের পরেও রোগীকে বাঁচানো যায় না। আমার চাচার ক্যানসার বর্তমানে স্টেজ-ফোরে আছে। এখন পর্যন্ত ছয়টা কেমোথেরাপি দিয়েছি। প্রতিটা থেরাপিতে সব মিলিয়ে ৪০ হাজার করে টাকা খরচ হয়েছে। এটা আমরা বেসরকারি হাসপাতালে করেছি। মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে থেরাপি দিলে এই খরচটা হয়তো ১০ হাজারের মধ্যে হয়ে যেত। একই থেরাপি ল্যাব এইডে করালে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগতো।
আর্থিক অনটনের কথা জানিয়ে বিল্লাল হোসেন বলেন, বর্তমানে উনার ঢাকায় এসে থেরাপি নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ফলে উনি বাসায় থেকে ওরাল থেরাপি নিচ্ছেন। এখানেও ওষুধের দাম প্রায় ১০ হাজার টাকা। যা প্রতি ২১ দিন পরপর একটা করে খেতে হয়। এছাড়াও আরও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা মনে হয়েছে তা হলো, খরচ বেশি, সঠিক হাসপাতাল ও চিকিৎসা না পাওয়া। মানুষ জানে না তারা কোথায় গেলে সঠিক চিকিৎসা পাবে। রোগী বাঁচবে বা সুস্থ হবে কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, যারা ঢাকা থাকে তারা কম-বেশি চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন ও চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে যারা আসেন, তাদের ভোগান্তিটা বেশি। তারা ঢাকায় এসে এসে চিকিৎসা নিতে পারেন না। এখন প্রতি জেলায় যদি ক্যানসারের সেবা পাওয়া সম্ভব হতো, সেটা সীমিত পরিসরে হোক; সিরিয়াল ধরেও তারা যেন সেবাটা নিতে পারে। এতে কিছুটা ভোগান্তি কম হতো।
পরিবারের মানসিক কষ্টের কথা উল্লেখ করে রোগীর এই স্বজন বলেন, ক্যানসার যখন ধরা পড়ে তখন স্টেজ-থ্রি বা ফোরে। এসব রোগীর যাদের সামর্থ্য আছে তারা কয়েক বছর চিকিৎসা নিয়ে মারা যাচ্ছে, খুব কমই সুস্থ হচ্ছে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা আমাদের মতো অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে আছে। একে তো রোগীর কষ্ট চোখের সামনে দেখছে, তার মধ্যে টাকা নেই বলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা করাতে পারছে না, সেই মানসিক কষ্ট। টাকা খরচ করলেও বাঁচবে না এমন একটি পরিস্থিতি, এটা রোগীর স্বজনদের জন্য মারাত্মক মানসিক কষ্টের।
ক্যানসারের শর্টকাট চিকিৎসা নেই
রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহানা পারভীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্যানসার একটি ক্রনিক ডিজিজ। ধরেন, সাধারণত জ্বর হলো, চিকিৎসার পর ভালো হয়ে গেল। হার্টের সমস্যা হলো, রিং বসালাম ভালো হয়ে গেল। কিন্তু ক্যানসারের বিষয়টি এমন নয়, রোগীরা আর্লি স্টেজে আসে না। যেমন: আক্রান্তের দিক থেকে মহিলাদের জরায়ু ক্যানসারের অবস্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়। আর এক নম্বর হলো স্তন ক্যানসার। ক্যানসার হাসপাতালের দশ বছরের একটা স্টাডি অনুযায়ী, ৯৫ শতাংশ জরায়ু ক্যানসার রোগী হাসপাতালে অ্যাডভান্স স্টেজে। অথচ এই রোগীটা যদি প্রাথমিক অবস্থায় আসতো তাহলে তাকে বাঁচানো যেত। হয়তো তার সার্জারি করা যেত অথবা রেডিয়েশন দিলে ভালো হয়ে যেত। অন্য ক্যানসারগুলোরও একই অবস্থা। আমরা জানি যে অ্যাডভান্স স্টেজে ক্যানসার কিউরেবল না। ফলে ওই রোগীকে প্যালিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট (কষ্ট কমানোর চেষ্টা) দেওয়া হয়। সেই রোগীটা আমরা সেবা দিয়ে মোটামোটি সুস্থ করলেও তা আবার ফিরে আসে।
বিদেশে চিকিৎসা ও দেশে ভোগান্তির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে যারা কিছুটা সামর্থ্যবান তারা ভারত চলে যায়। সেখানে গেলে ভালো হয়ে যাবে, এটা তাদের ধারণা। অথচ আমাদের এবং তাদের একই চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যয়বহুল বলা হয়, যদিও তা সরকারি নয়, বেসরকারিতে। আবার সরকারি হসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিন নাই, আবার যেসব মেশিন আছে সেই মেশিনগুলো কার্যকরী না। আবার রোগীদের এসব পেতে তিন থেকে চার মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। তখন তো তার রোগটা আরও খারাপ অবস্থায় যাবে। ফলে অনেক রোগী দেশের বাইরে গিয়ে তাদের সর্বস্ব হারান। বাড়ি-জমি বিক্রি করেও চিকিৎসাটা করায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আবার আমাদের কাছে ফেরত আসে। কারণ ফলোআপ চিকিৎসা করাতে এসে দেখে তার রোগটা আবার ফেরত এসেছে। কিন্তু ততক্ষণে তো তার জায়গা-জমি শেষ। এর এক পর্যায়ে রোগীরা চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
এমএইচ/জেবি