‘ক্যানসার’—একটি শব্দ, যা প্রতিবার উচ্চারণে জীবনের নীরব শত্রুর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই প্রাণঘাতী রোগটি প্রতিদিন লাখো মানুষের জীবনে অন্ধকার ডেকে আনে। অথচ, সময়মতো নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা পেলে ক্যানসারকে পরাজিত করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়ে গেছে, যা অনেকের জন্য জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান তৈরি করে। ক্যানসার প্রতিরোধ ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ২০২৫ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আসুন ক্যানসার সেবায় বৈষম্য দূর করি’ যা ক্যানসার সেবায় সমানাধিকার নিশ্চিতের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
ক্যানসার দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসা ও সেবায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা সুবিধা, অর্থনৈতিক অবস্থান এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকেই প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বৈষম্য দূর করতে সরকার, স্বাস্থ্য সংস্থা, চিকিৎসক এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এবারের দিবসটি ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বৈশ্বিক ক্যানসার পরিস্থিতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, ক্যানসার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। প্রতি বছর প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৬০ লাখ মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং বয়স বৃদ্ধির মতো কারণগুলো ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে ক্যানসার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার সুযোগ বেশি থাকলেও, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই সুবিধাগুলো সীমিত, যা বৈশ্বিক ক্যানসার ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য তৈরি করছে।
ক্যানসার মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, চিকিৎসা ও সেবায় বৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে। উন্নত দেশগুলোতে ক্যানসার রোগীদের জন্য উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি, ওষুধ এবং পুনর্বাসন সুবিধা সহজলভ্য হলেও, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই সুবিধাগুলো অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ ক্যানসার-সম্পর্কিত মৃত্যু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে, যেখানে চিকিৎসা পরিষেবা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে। এছাড়াও, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ক্যানসার চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে অনেক রোগী সময়মতো চিকিৎসা পাননি। বৈশ্বিক ক্যানসার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা, বিনিয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈষম্য দূর করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে ক্যানসার একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয় এবং প্রায় এক লাখ মানুষ ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে মুখ, ফুসফুস এবং খাদ্যনালীর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রধান। বিশেষ করে, জরায়ুমুখের ক্যানসার বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব রয়েছে, যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে প্রতিরোধযোগ্য। তবে, সচেতনতার অভাব, স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের সীমিত সুযোগ এবং চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা বাংলাদেশে ক্যানসার মোকাবিলায় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসা ও সেবায় বৈষম্য একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। দেশে মাত্র কয়েকটি বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়াও ক্যানসার চিকিৎসার উচ্চ খরচ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও প্রযুক্তির অপ্রতুলতা সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া কঠিন করে তুলেছে। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্যানসার রোগী চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন, যখন চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় ক্যানসার সচেতনতা এবং স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের অভাব রয়েছে, যা রোগ দ্রুত শনাক্তকরণে বাধা সৃষ্টি করে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধি, স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ এবং চিকিৎসা সুবিধা উন্নত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্যানসার মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
কোন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
২০২৩ সালের গ্লোবোক্যান ডাটা অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবযুক্ত ক্যানসারগুলোর মধ্যে স্তন ক্যানসার শীর্ষে রয়েছে। যা মোট ক্যানসার রোগীর প্রায় শতকরা ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপরই রয়েছে ফুসফুসের ক্যানসার (১২.২ শতাংশ), যা পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তৃতীয় স্থানে রয়েছে, কোলোরেক্টাল ক্যানসার (১০.৭ শতাংশ), যার প্রাদুর্ভাব উন্নত দেশগুলোতে বেশি। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে প্রোস্টেট ক্যানসার (৭.৩ শতাংশ) এবং পাকস্থলীর ক্যানসার (৫.৬ শতাংশ)। বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির পেছনে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা এবং পরিবেশ দূষণের মতো কারণগুলো দায়ী। উন্নত দেশগুলোতে স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সুবিধা বেশি থাকলেও, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে ক্যানসার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে ক্যানসারের ধরন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবযুক্ত ক্যানসার হলো মুখ ও গলার ক্যানসার (১৮.৫ শতাংশ), যার পেছনে তামাক ও ধূমপানের ব্যবহার প্রধান কারণ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফুসফুসের ক্যানসার (১৫.৮ শতাংশ)। নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার (২৭.৬ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যা মোট নারী ক্যানসার রোগীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জরায়ুমুখের ক্যানসার (২২.৪ শতাংশ), যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে প্রতিরোধযোগ্য। বাংলাদেশে ক্যানসার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় সচেতনতা, স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম এবং চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
বিশ্ব ও বাংলাদেশে ক্যানসারের চিকিৎসা
বিশ্বব্যাপী ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। উযুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো ক্যানসার চিকিৎসার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সুবিধা সহজলভ্য। এসব দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রোগ্রামও চালু রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নত দেশগুলোতে ক্যানসার রোগীদের বেঁচে থাকার হার প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ। তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ওষুধের অভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্যানসার চিকিৎসায় এই বৈষম্য দূর করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
অপরাপর মধ্যম ও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের মতো বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা সীমিত, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। দেশে মাত্র কয়েকটি বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও, কিছু বেসরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়া হয়, তবে সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণের অভাব, চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা এবং উচ্চ খরচ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হলেও, সেখানে রোগীর চাপ বেশি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে সামর্থ্যবান রোগীদের একটি বড় অংশ ক্যানসার চিকিৎসায় বিদেশমুখী।
ক্যানসার চিকিৎসা ও নিরাময়ে সর্বশেষ অগ্রগতি
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ক্যানসার চিকিৎসা ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইমিউনোথেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপি ক্যানসার চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছে। ইমিউনোথেরাপি, যেমন CAR-T cell therapy এবং Immune Checkpoint Inhibitors, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে সাহায্য করে। টার্গেটেড থেরাপি ক্যানসার কোষের নির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত করে সেগুলোকে অকার্যকর করে। এছাড়াও, প্রিসিশন মেডিসিন (Precision Medicine) এর মাধ্যমে রোগীর জিনোমিক প্রোফাইলিং করে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে, গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ক্যানসার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পরিকল্পনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তবে, এখনও ক্যানসারের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হয়নি, বিশেষ করে মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসারের ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানীরা ক্যানসার ভ্যাকসিন এবং জিন এডিটিং প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে ক্যানসার প্রতিরোধ ও নিরাময়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ক্যানসার চিকিৎসা ও গবেষণায় বেশ কিছু নতুন দিকনির্দেশনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার ক্যানসার শনাক্তকরণ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পরিকল্পনায় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, এআই-ভিত্তিক টুলস ব্যবহার করে ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার ফলাফল পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও, ক্যানসার ভ্যাকসিন এবং জিন এডিটিং প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা তীব্র গতিতে চলছে, যা ভবিষ্যতে ক্যানসার প্রতিরোধ ও নিরাময়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
এমএইচ/জেবি