শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

লোকগীতি সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ কি হারিয়ে যাবেন ক্যানসারে!

পুলক পুরকায়স্থ, মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৯ এএম

শেয়ার করুন:

লোকগীতি সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ কি হারিয়ে যাবেন ক্যানসারে!
প্রাণবন্ত এই মানুষটি এখন জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি। ছবি: ঢাকা মেইল

‘আমার শুয়া চাঁন পাখি, আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছো নাকি?’ গুনগুন করে এই গানটি গেয়ে গ্রামীণ মেঠোপথ থেকে শহরের পিচঢালা পথে ছুটে চলা লোকটি আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। নিজেই শুয়ে আছেন হাসপাতালের লোহার বিছানায়।

বলছি একজন লোকগীতির সংগ্রাহক ধামাইল প্রেমিক রামকৃষ্ণ সরকারের কথা। তিনি থাকেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওড়পারের রুস্তমপুর গ্রামে।


বিজ্ঞাপন


লুপ্তপ্রায় গীত খোঁজা রামকৃষ্ণ সংসারের অভাব অনটনকে পেছনে ফেলে ধামাইল নৃত্যগীতকে সারাদেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে গেছেন আপন মনে। এক মাস আগে তার বিরল মাল্টিপল মায়লোমা (এমএম) প্লাজমা কোষের একটি ক্যানসার ধরা পড়েছে। বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লোকগীত এবং লোকনৃত্য হিসেবে ধামাইল পরিচিত। বর্তমানে ধামাইল বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রুস্তমপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম রামকৃষ্ণ সরকারের। পরিবারের বড় সন্তান তিনি। জীবনের শুরু থেকেই দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে বেড়ে ওঠা তার। স্থানীয় আছিদউল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতেই ইতি টানেন শিক্ষাজীবনের। তাই পড়ালেখায় আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ছোটবেলা থেকেই সিলেট অঞ্চলের ধামাইলসহ অন্যান্য লোকজ গানের ওপর আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। পাশাপাশি কাজ করতেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তবু লুপ্তপ্রায় সিলেটি ধামাইল নৃত্যগীত সংগ্রহ এবং এর প্রচার করা থেকে একটুও পিছপা হননি। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানেই চাকরি জীবন স্থায়ী হয়নি। পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটে তিনি শ্রীমঙ্গলের আব্দুস শহীদ কলেজে অফিস সহায়ক পদে যোগ দেন, বর্তমানে সেখানেই কর্মরত।

স্থানীয়রা আরও জানিয়েছেন, পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ২০০৫ সালে তিনি শ্রীমঙ্গলে সর্বপ্রথম ধামাইল সংগঠন ‘ধামাইল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ধামাইলের প্রচার প্রসার ও উন্নয়নের লক্ষে কাজ করেন। এ পর্যন্ত তিনি সংগ্রহ করেছেন প্রায় পাঁচশ ধামাইলসহ অন্যান্য লোকজ গান। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'সিলেটি ধামাইল গীত' নামক ধামাইল গানের একটি বই। এভাবেই লুপ্তপ্রায় ধামাইল নৃত্যগীতকে সারাদেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি আপন মনে চালিয়ে যান তিনি।


বিজ্ঞাপন


রামকৃষ্ণ সরকারের স্ত্রী শুকলা রানী বলেন, আমাদের তিন মেয়ে সুমি, রুমি ও ঝুমি। সংসারে অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের পড়ালেখা খুব কষ্টে চলছে। বড় মেয়ে সুমি সরকারকে বিয়ে দিয়েছি। একদিকে স্বামী অসুস্থ অন্যদিকে চারজনের সংসার চালাতে গিয়ে এখন আমি চোখে পথ দেখছি না। স্বামীর চিকিৎসার টাকা ও সংসারের খরচ চালানোর সামর্থ্য আমার নেই। মেয়ের জামাই একটি এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সিলেটে চিকিৎসার খরচ হয়ে গেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। আমার স্বামীর সহপাঠী জয়ন্তদা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্যোগে উনি এখন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আছেন। দারদেনা করে স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করছি। জানি না এমন করে কতদিন তার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবো।

Moulovibazar2

লোকগীতি যেমন পছন্দ করেন ঠিক তেমনি বাবাকে গীত সংগ্রহের কাজেও সহায়তা করেন ছোট মেয়ে ঝুমি সরকার। তিনি বলেন, বাবার দুঃখ সিলেট অঞ্চলে লোকজ সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ধামাইলকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। এমনকি তাদের দরজায় বার বার ধর্ণা দিয়েও কোনো সহযোগিতা তিনি পাননি। শুধু পাওয়া গেছে আশার বাণী। অভাব অনটনের সংসারে বাবা লোকগীতিকে বাঁচাতে তার সারাটা জীবন চেষ্টা করেছেন। এখন সেই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখা চেষ্টা করছি।

রামকৃষ্ণ সরকারের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তার পরিবারের নেই। তাই তার চিকিৎসায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হৃদয়বান মানুষের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে পরিবারটি।

রামকৃষ্ণ সরকারের সহপাঠী শিক্ষক জয়ন্ত কুমার দেবনাথ ঢাকা মেইলকে বলেন, তিনি বেশ কয়েক দিন ধরে বিরল মাল্টিপল মায়লোমা নামক রোগে ভুগছেন। প্রথমে সিলেটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি (এভারকেয়ার) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যদিও তার বা তার পরিবারের সেই সামর্থ্য নেই, তবু শুধু তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে আমরা তাকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি। অনেকেই সহযোগিতা করেছেন, যা অপ্রতুল।

ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক সহজ সরল স্বভাবের রামকৃষ্ণ সরকারকে বাঁচাতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

মৌলভীবাজার সদর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. বিনেন্দু ভৌমিক ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিভাবান এই লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার মাল্টিপল মায়লোমা (এমএম) রোগে ভুগেছেন। এটা একধরনের ক্যানসার। এই রোগের চিকিৎসা অনেকটা দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যয়সাপেক্ষও বটে।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর