নাম শুনলেই মনে হয় নিশ্চিত মৃত্যু-এমন একটি রোগ হলো ক্যানসার। মরণব্যাধি এই ক্যানসারের থাবা এখন দেশজুড়ে। এরমধ্যে একটু বেশি এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। আবার এই বিভাগের মধ্যে এগিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা। মোট আক্রান্তের ৮১ শতাংশ ক্যানসার রোগী শুধু এই দুই জেলায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি সংশ্লিষ্টদের হিসাবমতে, চট্টগ্রামে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলে জানান চমেক হাসপাতালের ক্যানসার ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ।
বিজ্ঞাপন
এই চিকিৎসক বলেন, গত বছর চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬০ হাজারেরও বেশি ক্যানসার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার ৯৬৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন চমেক হাসপাতালে। যেখানে ক্যানসারে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৪৪৭ জন।
এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৩৩ জন ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। এর মধ্যে ক্যানসারে নতুন আক্রান্ত রোগী ছিল চার হাজার ৭৭২ জন। এছাড়া নগরীর শেভরণ, পার্কভিউ, এভারকেয়ার, ম্যাক্স ও পপুলার হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ক্যানসার আক্রান্ত অনেক রোগী।
চট্টগ্রামে কেন এত ক্যানসার রোগী?
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যানসার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ভেজাল খাদ্যগ্রহণ। এছাড়া তামাক সেবন, কাজিন ম্যারেজ বা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা অনেকটা দায়ী। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকিতে ডিটিটির ব্যবহার, ঝাল তরকারি ও লাল মাংস এই অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যানসারের বিষ।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজির অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি অব ইউকারেউটিক জিন এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফাংশন এবং চিটাগাং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিল্ড্রেন সার্জারি (ক্রিকস) যৌথ সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের প্রায় ১৫ শতাংশ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া উপজেলায়। ১৩ শতাংশ পটিয়া উপজেলায়। ১৩ শতাংশ উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। বাকি ১১ উপজেলায় রয়েছে ১১ শতাংশ। আর কক্সবাজার জেলায় রয়েছে ৩১ শতাংশ।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ৪০-৬০ বছর এবং ৫০-৬০ বছর এই দুই সময়ের মধ্যে। এই দুই বয়সসীমায় আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ করে।
চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় স্তন, জরায়ু, লিভার, ফুসফুস ও খাদ্যনালীর ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার রোগী বেশি। এসব এলাকার মানুষের মধ্যে এসব ক্যানসার কেন বেশি হচ্ছে তা গবেষণার বিষয়।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. আলী আসগর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মুখরোচক ঝালযুক্ত খাবার, ধুমপান, শুঁটকি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্যের প্রতি অসেচতনতা, খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের সংযুক্ততা ইত্যাদিই মূলত এই অঞ্চলের লোকদের ক্যানসার হওয়ার জন্য দায়ী। স্ক্রিনিংটা ভালোভাবে না হওয়ায় লোকজন এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছে না।
ডা. আলী আসগর বলেন, উপকূলের মানুষ সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি বেশি খায়। সমুদ্রে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হয়। এসব বিষাক্ত বর্জ্য সাগরের মাছের পেটে ঢোকে। এছাড়া শুঁটকি তৈরির সময় সারসহ একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।
এই চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশে যত মানুষ ক্যানসারে মারা যাচ্ছে তার ৬০ ভাগ মারা যাচ্ছে তামাক থেকে। ধোঁয়াবিহীন তামাকও রয়েছে এর সাথে। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা থাকতে হবে। সিগারেট, পান, জর্দা বর্জন করতে হবে।
চার ধরনের ক্যানসারের থাবায় চট্টগ্রামের মানুষ
চার ধরনের ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষ। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিগুণ। চমেক হাসপাতালে গত বছরের রোগী ভর্তি ও সেবার তথ্য পর্যালোচনায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
রোগীর সেবার সংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুস ও মুখগহ্বরের ক্যানসারেই আক্রান্ত হয়ে দ্বারস্থ হচ্ছেন চিকিৎসকের। আবার নারী পুরুষ উভয়ে আক্রান্ত হচ্ছে টিউমারজনিত ক্যানসারে।
গত বছরের রোগীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরুষ রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ রোগী মুখগহ্বরের, ১৭ শতাংশ ফুসফুস সংক্রান্ত, ১১ শতাংশ খাদ্যনালী, ৫ শতাংশ কোলেরেক্টাল, ৪ শতাংশ পাকস্থলী ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া বাকি ৪৪ শতাংশ পুরুষ অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
নারীদের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ নারী স্তন ক্যানসারে, ১৮ শতাংশ নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে, ১৩ শতাংশ নারী মুখগহ্বর ক্যানসারে, ৬ শতাংশ নারী খাদ্যনালী ক্যানসারে, ৫ শতাংশ ফুসফুসের এবং ৩৬ শতাংশ নারী অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের তুলনায় সচেতনতা বাড়লেও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আগে নারীদের জরায়ু ক্যানসারের হার বেশি থাকলেও এখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেড়েছে।
এছাড়া বিলম্বে বিয়ে, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে সন্তান নেওয়া এবং শিশু সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানোকে নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ বলেও মনে করছেন তারা। পুরুষদের ক্ষেত্রে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে তারা আক্রান্ত বলেও মত চিকিৎসকদের।
ক্যানসার জয়ী ব্যাংকার আবুল বশরের মুখে হাসি
আবুল বশর। বয়স ৬৫। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিশনাল ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। অবসর নিয়েছেন ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এর মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। চাকরির সাথে দীর্ঘ ১২ বছর যুদ্ধের পর তিনি এখন ক্যানসারমুক্ত।
ক্যানসার জয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে ফুটফুটে গোলাপের মতো মুখে হাসি ছড়িয়ে দেন তিনি। সম্প্রতি সাক্ষাতের শুরুতে তিনি বলেন, আমাকে কি রোগীর মতো লাগছে?
আসলে আবুল বশরের চেহারা দেখলে বোঝা মুশকিল তিনি অসুস্থ। কিন্তু তিনি হাঁটছেন স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে। তারপরও তৃপ্তির হাসি দিয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেফাতুজ্জাহান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যখন বলেন, আমার শরীরে ক্যানসারের কোনো জার্ম নেই। তখন আমার খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল ডা. শেফাতুজ্জাহান আমার সন্তানের মতো। কারণ তার চিকিৎসায় আমি নতুন জীবন পেয়েছি।
আবুল বশর বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের বলতে চাই, আপনারা সুচিকিৎসা চাইলে ডা. শেফাতুজ্জাহানের কাছে আসুন। উনার থেকে চিকিৎসা নিন। উনি এমন একজন ডাক্তার, প্রয়োজনসাপেক্ষে ক্যানসার রোগীদের নিয়ে প্রচুর স্টাডি করেন। তারপর চিকিৎসা ব্যবস্থা দেন।
ক্যানসার জয়ের আগে আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে আবুল বশর বলেন, ২০১১ সালের শেষের কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমার মেরুদণ্ডে ব্যথা অনুভূত হয়। তখন চট্টগ্রামের একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি বলেন, আমার টিউমার হয়েছে। পরামর্শ দেন অপারেশনের। পরে পপুলার হাসপাতাল, এপোলো হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসকদের শরণান্ন হই। কিন্তু চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় অপারেশনে অপারগ ছিলাম।
একপর্যায়ে চট্টগ্রামের একজন হোমিও বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নিই। এতে বছর দেড়েক ব্যথামুক্ত জীবন কাটায়। পরে ব্যথা শুরু হলে হোমিও বিশেষজ্ঞ পরামর্শে ফের পপুলার হাসপাতালের শরাণাপন্ন হই। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা হয় টিউমার ক্যানসার। তখন যমদূতকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তবুও নিরুপায় হয়ে পপুলার হাসপাতালে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই। সেই অপারেশনের পরও ব্যথা কমেনি। পরে পিজি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলা হয় অপারেশন হয়েছে আংশিক। টিউমার পুরোটাই রয়ে গেছে ভেতরে।
এরপর পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে ফের অপারেশনে গেলাম। এরপর কয়েক বছর ভালো ছিলাম। কিন্তু আমি একরকম পঙ্গু হয়ে যাই। স্ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। পরে ফের ব্যথা শুরু হয়। তখন আমি এক প্রকার কাহিল হয়ে পড়ি। এ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা আমাকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান ডা. শেফাতুজ্জাহানের কাছে রেফার করেন। ব্যাংকে চাকরির সুবাধে আমিও থাকতাম হাসপাতালের কাছে আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনিতে। সেখানে থেকে দীর্ঘ এক বছরের চিকিৎসায় আমি ক্যানসারমুক্ত। তবে এই চিকিৎসায় আমার ৬০ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে।
কাঁদছেন ক্যানসার আক্রান্ত পলাশ কান্তি দাশ
ক্যানসারকে জয় করে ব্যাংকার আবুল বশর হাসলেও অঝোরে কাঁদছে ক্যানসার আক্রান্ত পলাশ কান্তি দাশ। তার বাড়ি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায়।
গত এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। পলাশ কান্তি দাশ জানান, প্রতিদিন চিকিৎসায় তার ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। যা কেনা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। টাকার অভাবে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে হয়তো তাকে মরতে হবে।
তিনি বলেন, আমার দুটি ছেলে আছে। এদের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। কারণ এরা এখনো ছোট। আমি মারা গেলে আমার স্ত্রী-সন্তানদের দেখার কেউ নেই। আমার একজন ছোট ভাই ছিল, সেও কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমার মা-বাবাও কেউ বেঁচে নেই। আমার সন্তানদের মানুষ করার মতো কেউ থাকবে না, যদি আমি মারা যাই। এ কথা বলেই কেঁদে ফেলেন তিনি।
ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার গল্প জানাতে গিয়ে পলাশ কান্তি দাশ বলেন, মাত্র ছয় মাস আগে আমি সাংসারিক কাজে একটি বাঁশের সাথে বুকে আঘাতপ্রাপ্ত হই। এতে বুকে ব্যথা শুরু হলে আমি চমেক হাসপাতালে যাই। সেখানে পরীক্ষার পর বুকের ভেতর টিউমার ধরা পড়ে। পরে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান টিউমার ক্যানসারের কথা। যা শুনে আমি মৃত্যুপুরীতে চলে গিয়েছিলাম।
আর চমেক হাসপাতালে অপারেশন ও চিকিৎসা খরচের কথা শুনে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় আমার। শেষ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। প্রতিদিন আমাকে যে পরিমাণ ওষুধ খেতে হয় তার অর্ধেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেন। বাকি ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ খরচ যায় আমার। যা যোগান দেওয়া আমার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় খরচ কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছি বেঁচে থাকার আশায়।
ব্যথা কমাতে টাকা উড়াচ্ছেন আবদুল মান্নান
দুই মাস আগে হঠাৎ গলায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বখতপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আবদুল মান্নান। শুরুতে স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নিলেও পরে বিশেষায়িত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। তবে নানা পরীক্ষা চলতে থাকে রোগ নির্ণয়ে। পরে জানা যায়, ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত তিনি।
মান্নানের এক স্বজন বলেন, এখন যে অবস্থায় ধরা পড়েছে, এটা একেবারে শেষ পর্যায়ে। ফলে বেঁচে থাকার আশা একরকম ছেড়ে দিয়েছেন আবদুল মান্নান ও পরিবারের স্বজনরা। যারা বুক ভরা ব্যথা চাপা দিয়ে আবদুল মান্নানের গলা ও পেটের ব্যথা কমাতে ব্যয় করছেন লাখ লাখ টাকা। গেছেন ভারতেও। ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় বর্তমানে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। সব মিলিয়ে মান্নানের চিকিৎসায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন বলে জানান স্বজনরা।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে চিকিৎসাধীন মহরম আলী ঢাকা মেইলকে জানান, তার ক্যানসার ধরা পড়েছে গলায়। তিনি প্রতিদিন এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি খেতেন। সাথে পান-জর্দা খাওয়ার অভ্যাসও ছিল। একই বিভাগে ভর্তি রণজিত কুমারও প্রচুর ধুমপান করতেন। অ্যালকোহলও খেতেন। ২-৩ মাস আগে তার বমি হতো। পেটেও ব্যথা লাগতো। পরে জানলেন, তার ক্যানসার।
দুই বছর আগে চতুর্থ বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে গর্ভফুল ছিড়ে গিয়েছিল শারমীন আক্তারের। বাড়িতে সারাদিন রেখে তাকে রাতে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও এরপর থেকে তার তলপেটে ও প্রস্রাবের রাস্তায় ব্যথা অনুভব হতো। প্রথমে ডাক্তার দেখিয়েছেন গ্রামে। পরে ব্যথা তীব্র হয়ে উঠলে চমেক হাসপাতালে এসে বর্হিবিভাগে দেখান। সেখানেই ধরা পড়ে তার জরায়ুতে ক্যান্সার। এরপর বিভিষিকাময় জীবন শুরু হয় বলে জানান শারমীন আক্তার।
অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা, ভোগান্তি ক্যানসার রোগীদের
চট্টগ্রামে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়লেও নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে মলিক্যুলার ল্যাব না থাকায় ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে দেরিতে। পাশাপাশি বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয়। রোগ নির্ণয়ে ছুটতে হচ্ছে ঢাকা বা দেশের বাইরে।
ভুক্তভোগীরা জানান, জটিল রোগের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করতে করতেই রোগীর অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। এতে একদিকে ভোগান্তি বাড়ে, অন্যদিকে খরচ বাড়ে কয়েক গুণ। তবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশেষায়িত ক্যানসার ইউনিটের কাজ চলছে।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আসগর চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, চমেক হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ৭০ জনের বেশি রোগী আসছেন। রোগ শনাক্তে অত্যাধুনিক মলিক্যুলার ল্যাব না থাকায়, ক্যানসার শনাক্তে নানা জায়গায় ঘুরতে হয় রোগীদের।
এই চিকিৎসক বলেন, মলিক্যুলার ল্যাবের মাধ্যমে যে টার্গেট থেরাপি লাগবে অথবা রেডিও থেরাপি বা জিন থেরাপি, ক্ষেত্রে আমরা এটা করতে পারছি না। আরও ইমপরটেন্ট লিকুইড বায়োপসি। এটাতে আমরা আরও দেখতে পারি যে জিনেটিক্যালি এটা ক্যানসার হবে কি না।
চমেক হাসপাতালের ক্যানসার ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আগের তুলনায় দেশে ক্যানসার চিকিৎসার পরিসীমা বাড়লেও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষায়িত ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, সামনে এ রোগের নিরাময় আরও উন্নত হবে বলে আশাবাদী। তবে মানুষের সচেতনা বাড়লেই এ রোগ থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকা সম্ভব।
ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীর সেবায় কাহিল জেসমিন
ক্যানসারে আক্রান্ত আলাউদ্দিন (৩৫)। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মরণদশা তার। আর একই সাথে স্বামীর সেবায় কাহিল প্রায় স্ত্রী জেসমিন আক্তার।
গত ২৫ জানুয়ারি স্বামী আলাউদ্দিনকে নিয়ে চমেক হাসপাতালের ক্যানসার ওয়ার্ডে আসেন জেসমিন আক্তার। ওয়ার্ডের এক জায়গায় বসে স্বামীর মেরুদণ্ড মেসেজ করছেন জেসমিন।
জেসমিন আক্তার বলেন, স্বামী আলাউদ্দিন গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। সুখেই যাচ্ছিল তাদের দিন। কিন্ত তিন বছর আগে হঠাৎ তার পিঠে ব্যথা শুরু হয়। প্রথমে গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীতে এক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তিনি লিখে দেওয়া ওষুধ খেলেও ব্যথা কমেনি।
পরে ওই চিকিৎসকের পরামর্শে চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে এক চিকিৎসকের কাছে যাই। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়ার পর বলেন, টিউমারে ক্যানসার। যা শুনে অন্ধকার হয়ে আসছিল পৃথিবী। পরে স্বামীকে ভর্তি করা হয় চমেক হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি ছিলাম প্রায় তিন মাস।
এ অবস্থায় স্বামীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পায়খানা-প্রস্রাব করানো, খাওয়া-দাওয়া করা সব করতে হয় আমাকে। এছাড়া ওষুধ খাওয়ানোসহ নানা সেবা করতে হয়। এসব করতে গিয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। যা এখনো পর্যন্ত চলছে।
হাসপাতালে চিকিৎসায় একটু ভালো লাগলেও বেঁচে থাকার মতো অবস্থায় নেই স্বামী আলাউদ্দিনের। স্বামীর সাথে আমিও যেন মৃত্যুর দিকে হেঁটে চলেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি-এমন রোগ যেন শত্রুরও না হয়।
ভরসার জায়গা চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল
চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ক্যানসার রোগীর সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে শুধু চমেক হাসপাতালে। হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ক্যানসার রোগী আসছেন ১৫০-২০০ জন। এ বিভাগে ইনডোর সিট রয়েছে ২৪টি।
এছাড়া গত বছর নতুন ও পুরাতন মিলে চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ হাজার ৯৬৫ জন ক্যানসার রোগী। এরমধ্যে নতুন রোগী ছিল ছয় হাজার ৪৪৭ জন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫ হাজার ৬৩৩ জন ক্যানসার রোগী। এর মধ্যে নতুন রোগী ছিল চার হাজার ৭৭২ জন।
সংখ্যায় কম হলেও চিকিৎসা সুবিধার কারণে এ হাসপাতালে ক্যানসার রোগী ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে ৬০ শয্যায় ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ এই হাসপাতালে ১২০ শয্যায় ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার সক্ষমতা রয়েছে।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজনের ভাষ্য, সরকারি হলেও চমেক হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়। রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি না থাকায় ঢাকা ও দেশের বাইরে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় ও দুর্ভোগ বাড়ছে।
পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর স্বজন বলেন, এই হাসপাতালে এখন খুব দ্রুত রোগ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে। সিটি সিমুলেটর, লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনসহ অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি রয়েছে এই হাসপাতালে। যদিও এই সুবিধার কথা এখনো অজানা অনেকেরই।
হাসপাতালের অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেফাতুজ্জাহান বলেন, মাত্র তিন বছর আগে এই হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়। যা এখন ক্যানসার ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রামের মানুষের সহযোগিতায় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক চেষ্টায় এই হাসপাতালে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এই মেশিনের কারণে হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা অনেকটা এগিয়ে গেছে। আর এটা শুধু হাসপাতাল নয়, মেডিকেল কলেজও। এখানে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিমও।
তিনি বলেন, ক্যানসার রোগ জটিল, তবে দুরারোগ্য নয়। প্রাথমিক অবস্থায় সুচিকিৎসা পেলে এই রোগ জয় করা সম্ভব। এছাড়া এই রোগ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ভেজাল খাবার গ্রহণে সচেতন হওয়া। এ বিষয়ে সরকারেরও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ভেজাল খাবারের কারণে বাংলাদেশ এখন ক্যানসার রোগীর কারখানা হয়ে গেছে। এই সুযোগে প্রতিবেশী দেশ ভারত ক্যানসার চিকিৎসার কারখানা বানিয়ে ফেলেছে। আমরা এই দুই কারখানা রিমুভ করতে চাই। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ ভেজাল খাবার গ্রহণে সচেতনতার ওপর কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। আবার ভারতের চিকিৎসা কারখানা ভাঙতে গরিব ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিনামুল্যে ওষুধ প্রদান করছে। এ কারণে ক্যানসার রোগীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ।
আইকে/জেবি