ছিলেন তুখোড় সাংবাদিক। কাজ করেছেন দেশের একাধিক নামকরা টেলিভিশন চ্যানেলে। সংবাদ সংগ্রহের জন্য দিনভর ছুটে বেড়িয়েছেন সাভারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। আর দশজন সংবাদকর্মীর মতো সঞ্জীব কুমার সাহারও নানা স্বপ্ন ছিল তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার নিয়ে। কিন্তু হঠাৎই শরীরে ধরা পড়ল মরণব্যাধি ক্যানসার। তারপর?
দুঃসময়ের শুরু
বিজ্ঞাপন
২০২১ সালের শুরুর দিকে একদিন পেটের ডান পাশে হঠাৎ ব্যথার শুরু, ক্রমেই তা অসহ্য হতে থাকল। পরে পরিবারের সদস্যরা তাকে বাসার পাশেই একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে কিছু পরীক্ষা করিয়ে জানান, তার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। তবে সেটি আকারে খুবই ছোট। আপাতত অস্ত্রোপচার না করলেও চলবে। এরপর বাসায় ফিরে এসে চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেতে থাকেন। কিন্তু কয়েক মাস পর আবারো ব্যাথা শুরু। পানি ছাড়া কিছুই খেতে পারছিলেন না তখন। এভাবে কয়েক দিন যাবার পর সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, ইমার্জেন্সি তার পেটে অস্ত্রোপচার করতে হবে। নয়ত তাকে বাঁচানো যাবে না। পরে অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর পেটে বিশাল এক টিউমারের অস্তিত্ব খুঁজে পান চিকিৎসকরা। তাৎক্ষণিক সেটি কেটে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর বায়োপসি করানোর পর জানা যায়, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে দূরারোগ্য ক্যানসার।
এমন খবরে চারপাশের সাজানো পৃথিবীটা মুহূর্তে খানখান হয়ে যায় সঞ্জীবের। যদিও শুরুতে তাকে সে কথা জানানো হয়নি। পরিবার থেকে প্রস্তুতি চলছিল অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে আবারও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর। এসব দেখে তার ছোট ভাইকে প্রশ্ন করেন সঞ্জীব; 'আমার অসুখের নাম কী?’ আর তখনই জানতে পারেন, তিনি ক্যানসার আক্রান্ত। তখন তিনি শুধু বলেছিলেন, 'এত লুকাচাপার কিছু নেই। আমাকে বললেই হতো।'
ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস
বিজ্ঞাপন
বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সঞ্জীবকে ভারতে নেওয়া হবে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাইরে যাবে না দেশেই চিকিৎসা করাবেন এবং মরলে দেশের মাটিতেই মারা যাবেন। পরে তিনি নিজেই খুঁজতে থাকলেন দেশের সবচেয়ে ভালো ক্যানসার চিকিৎসককে। এর মধ্যে খোঁজ পেলেন রাজধানীর বেসরকারি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মোয়ারফ হোসেনের। তারপর সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন সঞ্জীব। চিকিৎসক তাকে দেখে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে বললেন- এগুলোর রিপোর্ট নিয়ে আসুন, তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেব আপনার ক্যানসারের চিকিৎসা লাগবে কি না। ডাক্তারের এমন কথায় সঞ্জীব সাহা যেন এক চিলতে আশার আলো দেখতে পান। তখন সবাই প্রার্থনা করতে থাকলেন- এই বায়োপসি রিপোর্ট যেন ভুল হয়। সঞ্জীবের মনেও সেই আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা আর আশার মাঝে বিশাল ফারাক দেখতে পেলেন তিনি। আশা ছিল ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলবেন কিছু হয়নি, কিন্তু সেটা আর হলো না। চিকিৎসক রিপোর্ট রিভিউ করে তাকে এইট সাইকেলের কেমোথেরাপি দিলেন। আশাহত হওয়ার ওই মুহূর্ত দারুণ ধাক্কা দিয়েছিল সঞ্জীবকে। তারপর তিনি ভাবলেন, এই সত্যকে মেনে নিতে হবে।
এরপর শুরু হওয়া তার বেঁচে থাকার এই নতুন যুদ্ধ নিয়ে সঞ্জীব ঢাকা মেইলকে বলেন, 'একুশ দিন পর পর কেমো নিলাম টানা আট মাস। শরীরে কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিল দ্রুতই।'
এত বছর নিজেকে যেমন দেখেছিলেন সঞ্জীব, হঠাৎ নিজেই নিজেকে নতুন চেহারায় দেখতে পেলেন। 'কেমো নেওয়ার পর আমার চুল পড়তে শুরু করল। তখন আমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এটা আমার নতুন একটা চেহারা। আমার যে খুব মন খারাপ হলো তা না। কিন্তু আমার পরিবারের সদস্যদের খুব মন খারাপ হলো। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখগুলো ছলছল করছে।'
হাসপাতালে কেমোথেরাপি নিতে আসা ‘বাচ্চা থেকে বয়স্ক’ অনেক রোগী দেখেছিলেন সঞ্জীব। তাদের মাঝে থেকে আরও শক্ত করে নিয়েছিলেন নিজেকে।
'আমি আসলে আমার মতো অনেককে দেখেছিলাম, তাই মন খারাপ হয়নি। আসলে চল্লিশ বছর ধরে আমি আমাকে এক রকম দেখেছি। তারপর হঠাৎ করে আমাকে সবকিছু অন্যরকমভাবে শিখতে হচ্ছে। এটা খুব একটা সহজ ব্যাপার না। পরিবেশ সবকিছুই চেনা কিন্তু যাত্রাটা নতুন করে শুরু হয়। পেটে আইলোস্টোমি ব্যাগ নিয়ে টানা ১১টি মাস চিত হয়ে শোয়া অবস্থায় পার করতে হয়েছে প্রতিটি রাত। এরপর আবারো পেটে আরেকটি অস্ত্রোপচার করাতে হয়, সেটি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলোরেক্টাল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন শেখ।'
এই সময়টায় ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে নিজের শরীর ও মনকে নতুন করে জানার এই যাত্রায় সঞ্জীব কুমার সাহাকে সাহস ও শক্তি যুগিয়ে গেছেন তার পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মীদের সর্বাত্মক ভালোবাসা এবং সহযোগিতা পাশাপাশি ডাক্তারের কাউন্সেলিং।
সুসময়ের প্রত্যাবর্তন
সব চিকিৎসা মিলিয়ে কেটে যায় পুরো একটা বছর। এরপর আবার পরীক্ষা। এবার রিপোর্ট হাতে নিয়ে সঞ্জীব বিজয়ীর হাসি মুখে বাসায় এলেন। চিৎকার করে তিনি বলতে লাগলেন- সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমি পেরেছি। ক্যানসারের মতো একটা অসুখ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি আমার সুন্দর জীবনে। আমাকে আর কেমো বা রেডিওথেরাপির মতো যন্ত্রণায় যেতে হবে না। তবে বাকি জীবনটা নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তিনি জানান, 'এরপর আমি সবদিক থেকেই ভালো আছি। শুধু একটা চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াই যে, আবার আগের মতো সেই মাঠের সাংবাদিকতায় আর পুরোপুরি ফিরতে পারবো না। ক্যানসারকে পরাজিত করেছি আজ প্রায় দুই বছর। এই পুরো সময় আমি সবার অসংখ্য ভালোবাসা, স্নেহ আর প্রার্থনা পেয়েছি। যদিও এখনো দুই মাস পরপর আমাকে পরীক্ষা করাতে হয়, কিন্তু এর বাইরে আমি ভালো আছি। সুখেই কেটে যাচ্ছে জীবনটা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ মেটানোর কারণে কিছুটা আর্থিক কষ্টে থাকলেও, যেই নিঃশ্বাস আমি হারাতে বসেছিলাম, সেটা এখন আমি বুক ভরে নিতে পারছি। ক্যানসার আমাকে আক্রান্ত করেছিল, কিন্তু পরাজিত করতে পারেনি।’
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করালে ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। এ ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক মানুষের মতোই চলবে। তবে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলেও চিকিৎসকের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। শারীরিক যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জানাতে হবে বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
প্রতিনিধি/জেবি