বিশ্বের অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ক্যানসার একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয় এবং প্রায় এক লাখ মানুষ ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে মুখ, ফুসফুস এবং খাদ্যনালীর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রধান।
বিজ্ঞাপন
তথ্য বলছে, মরণব্যাধি এই ক্যানসারের থাবা এখন দেশজুড়ে। এরমধ্যে একটু বেশি এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। আবার এই বিভাগের মধ্যে এগিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা। মোট আক্রান্তের ৮১ শতাংশ ক্যানসার রোগী শুধু এই দুই জেলায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি সংশ্লিষ্টদের হিসাবমতে, চট্টগ্রামে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলে জানান চমেক হাসপাতালের ক্যানসার ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ।
এই চিকিৎসক বলেন, গত বছর চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬০ হাজারেরও বেশি ক্যানসার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার ৯৬৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন চমেক হাসপাতালে। যেখানে ক্যানসারে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৪৪৭ জন।
এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৩৩ জন ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। এর মধ্যে ক্যানসারে নতুন আক্রান্ত রোগী ছিল চার হাজার ৭৭২ জন। এছাড়া নগরীর শেভরণ, পার্কভিউ, এভারকেয়ার, ম্যাক্স ও পপুলার হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ক্যানসার আক্রান্ত অনেক রোগী।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রামে কেন এত ক্যানসার রোগী?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যানসার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ভেজাল খাদ্যগ্রহণ। এছাড়া তামাক সেবন, কাজিন ম্যারেজ বা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা অনেকটা দায়ী। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকিতে ডিটিটির ব্যবহার, ঝাল তরকারি ও লাল মাংস এই অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যানসারের বিষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজির অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি অব ইউকারেউটিক জিন এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফাংশন এবং চিটাগাং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিল্ড্রেন সার্জারি (ক্রিকস) যৌথ সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের প্রায় ১৫ শতাংশ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া উপজেলায়। ১৩ শতাংশ পটিয়া উপজেলায়। ১৩ শতাংশ উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। বাকি ১১ উপজেলায় রয়েছে ১১ শতাংশ। আর কক্সবাজার জেলায় রয়েছে ৩১ শতাংশ।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ৪০-৬০ বছর এবং ৫০-৬০ বছর এই দুই সময়ের মধ্যে। এই দুই বয়সসীমায় আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ করে।
আরও পড়ুন
চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় স্তন, জরায়ু, লিভার, ফুসফুস ও খাদ্যনালীর ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার রোগী বেশি। এসব এলাকার মানুষের মধ্যে এসব ক্যানসার কেন বেশি হচ্ছে তা গবেষণার বিষয়।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. আলী আসগর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মুখরোচক ঝালযুক্ত খাবার, ধুমপান, শুঁটকি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্যের প্রতি অসেচতনতা, খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের সংযুক্ততা ইত্যাদিই মূলত এই অঞ্চলের লোকদের ক্যানসার হওয়ার জন্য দায়ী। স্ক্রিনিংটা ভালোভাবে না হওয়ায় লোকজন এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছে না।
ডা. আলী আসগর বলেন, উপকূলের মানুষ সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি বেশি খায়। সমুদ্রে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হয়। এসব বিষাক্ত বর্জ্য সাগরের মাছের পেটে ঢোকে। এছাড়া শুঁটকি তৈরির সময় সারসহ একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।

এই চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশে যত মানুষ ক্যানসারে মারা যাচ্ছে তার ৬০ ভাগ মারা যাচ্ছে তামাক থেকে। ধোঁয়াবিহীন তামাকও রয়েছে এর সাথে। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা থাকতে হবে। সিগারেট, পান, জর্দা বর্জন করতে হবে।
চার ধরনের ক্যানসারের থাবায় চট্টগ্রামের মানুষ
চার ধরনের ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষ। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিগুণ। চমেক হাসপাতালে গত বছরের রোগী ভর্তি ও সেবার তথ্য পর্যালোচনায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
রোগীর সেবার সংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুস ও মুখগহ্বরের ক্যানসারেই আক্রান্ত হয়ে দ্বারস্থ হচ্ছেন চিকিৎসকের। আবার নারী পুরুষ উভয়ে আক্রান্ত হচ্ছে টিউমারজনিত ক্যানসারে।
গত বছরের রোগীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরুষ রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ রোগী মুখগহ্বরের, ১৭ শতাংশ ফুসফুস সংক্রান্ত, ১১ শতাংশ খাদ্যনালী, ৫ শতাংশ কোলেরেক্টাল, ৪ শতাংশ পাকস্থলী ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া বাকি ৪৪ শতাংশ পুরুষ অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
নারীদের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ নারী স্তন ক্যানসারে, ১৮ শতাংশ নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে, ১৩ শতাংশ নারী মুখগহ্বর ক্যানসারে, ৬ শতাংশ নারী খাদ্যনালী ক্যানসারে, ৫ শতাংশ ফুসফুসের এবং ৩৬ শতাংশ নারী অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের তুলনায় সচেতনতা বাড়লেও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আগে নারীদের জরায়ু ক্যানসারের হার বেশি থাকলেও এখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেড়েছে।
এছাড়া বিলম্বে বিয়ে, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে সন্তান নেওয়া এবং শিশু সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানোকে নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ বলেও মনে করছেন তারা। পুরুষদের ক্ষেত্রে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে তারা আক্রান্ত বলেও মত চিকিৎসকদের।
আইকে/ইএ