দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গ্লোবোক্যান ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে বহু রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব ও আর্থিক অনটনে মাঝপথেই থেমে যেতে বাধ্য হন। এর অন্যতম কারণ সরকারি পর্যায়ে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। দেশে বিপুলসংখ্যক রোগী থাকলেও ক্যানসার চিকিৎসা রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। আর ক্যানসার চিকিৎসার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে।
মাত্র ৫০০ শয্যার এই বিশেষায়িত হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধাও অত্যন্ত সীমিত। প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হতে আসছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সিটের অভাবে দিনের পর দিন হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা বা আশপাশের ভাড়া বাসায় কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। রোগীদের অসহায় পরিস্থিতি আর দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণা ক্যানসার চিকিৎসার চেয়েও কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর পাশের কাঞ্চন এলাকার বাসিন্দা সেলিম বেগম হাসপাতালের নিচতলায় বোনকে নিয়ে বসে আছেন। লক্ষ্য হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া। রোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, জরায়ুতে টিউমার। আগে কয়েক বার ডাক্তার দেখিয়েছেন, এখানে আসার পর চিকিৎসকরা হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন। ছেলে ভর্তির বিষয়ে কথা বলতে গেছে। তাই তিনি বোনকে নিয়ে ছেলের অপেক্ষায় আছেন।
সেলিমা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এক-দেড় মাস যাবত সমস্যা। ডাক্তার বলেছে জরায়ুর মধ্যে টিউমার। ভর্তির জন্য সিট দিয়ে তা অন্যকে দিয়ে দিয়েছে। আমরা সিট পাইনি। হাসপাতাল থেকে বলছে, ব্যবস্থা করছে। আমার ছেলেও একই কথা বলে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে। আমরা দুই বোন এখানে বসে আছি। ভর্তি দেয়, সিট দেয় না। এটা কেমন কথা।’
তার বোন আছিয়া বেগম বলেন, ‘ডাক্তার তো কতখানে দেখাইছি। কালকে এখানে আবার দেখাইলাম। এটা ভর্তি হইতে কইছে, কিন্তু সিট দিতাছে না। আমরা কিছু চিনি না, বুঝিও না।’
বিজ্ঞাপন
দুই তলায় লিফটের সামনে কথা হয় কিশোরগঞ্জ থেকে আসা রায়হান আহমেদের স্বজনদের সাথে। তারা বলেন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে এসেছি। দশ দিন যাবত হাসপাতালে, কিন্তু সিট পাইনি। দশ দিনের চেষ্টার পর অবশেষে সিট পেয়েছি। এর মধ্যে ডাক্তার দেখিয়েছি, আর অনেক টেস্ট করিয়েছি।
এই কদিন তারা কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে আব্দুল কাদির নামে রোগীর স্বজন বলেন, আত্মীয়-স্বজনের বাসা, হোটেল কিংবা হাসপাতালের বারান্দায় থেকেছি। এখানে রোগীদের জন্য বাসা পাওয়া যায়। চুক্তিতে বা যে কয়দিন থাকব দিন হিসেবে অনেকেই বাসা ভাড়া দেয়।
রোগীর বিষয়ে তিনি বলেন, কোন ক্যানসার হয়েছে তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে গলা ফুলে যায়, আর ব্যথা। থাইরয়েড বা টনসিলেন সমস্যা। এর আগে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল চিকিৎসা নিয়েছে। রায়হানের বাবা চাকরির জন্য ওইখানে থাকে। সমস্যা দেখা দেওয়ায় সিলেট নিজের কাছে নিয়ে গেছিল। তারা এখানে পাঠিয়েছে। সিট না দিলেও ডাক্তাররা ওষুধ দিয়েছে।
ফলোআপে আসা রোগীদের ভিড়
এদিকে নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের পাশাপাশি ফলোআপে আসা রোগীদের ভিড়ও লক্ষ্য করা গেছে। রোগী ও স্বজনদের জন্য নির্ধারিত বসার চেয়ারে জায়গা না হওয়ায় অনেককেই হাসপাতালের মেঝেতে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের একজন ১৯ বছর বয়সী লাবণী। শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল এই তরুণী কথা বলার অবস্থাতেই নেই। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছেন। পাশেই বাবা ও ভাই দাঁড়িয়ে।
লাবণীর মা কামরুন্নাহার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ভর্তি হবো না। আমরা ডাক্তার দেখাতে এসেছি। এর আগে এখানে দেড় মাস ভর্তি ছিলেন। অপারেশনও করাইছি। এক বছরের বেশি সময় অসুস্থ। অপারেশনের পরেও ভালো হয়নি। বলেছিল কয়েক দিন পর আসতে, তাই এসেছি। এখানে বেশির ভাগ পুরাতন রোগী। এমনকি বছর পাঁচেকের পুরাতন রোগীও আছে।
সক্ষমতার তুলনায় কয়েক গুন রোগী হওয়ায় বিপত্তি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহানা পারভীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ক্যানসার হাসপাতালে প্রতিদিন ন্যূনতম ১৫০০ রোগী আসে। বিপরীতে কাগজে-কলমে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৫০০। কিন্তু ওয়ার্কিং বেড এত নয়। এ অবস্থায় আমরা কতজনকে ভর্তি করতে পারবো? বাকি রোগীরা কোথায় যাবে? আর একটা বেডে আজকে ভর্তি করলে রোগী তো আগামীকাল চলে যাবে না। ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী। সুতরাং প্রতিদিন এতসংখ্যক রোগী ভর্তি করা সম্ভব হয় না।’
রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বেড থাকুক বা না থাকুক, রোগীর চিকিৎসা অবশ্যই হবে। এখন ক্যানসারের চিকিৎসাটা কী? সেটা হয় সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং শেষ মুহূর্তে পেডিয়াট্রিক। এই সব সেবা আমাদের হাসপাতালে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে শুরু করে ভর্তিসহ যতদিন আসবে ততদিন তার সেবা হবে। যার যে সমস্যা সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিচ্ছি। সরকার অনেক ওষুধ ও কেমোথেরাপির মেডিসিনও ফ্রিতে দিচ্ছে। কিন্তু এতসংখ্যক রোগীকে আমরা তার টাইম পিরিয়ডের মধ্যে আইডিয়াল চিকিৎসা দিতে পারছি না।’
এমএইচ/জেবি