শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

শিশুদের ক্যানসার: যা জানা প্রয়োজন

ডা. রিফাত আল মাজিদ ভূইয়া
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

শিশুদের ক্যানসার: যা জানা প্রয়োজন
শিশুদের ক্যানসার প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা। ছবি: সংগৃহীত

শিশুদের ক্যানসার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এটি শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় চার লাখ শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তবে আধুনিক চিকিৎসা ও উন্নত স্ক্রিনিং পদ্ধতির ফলে এখন অনেক ক্ষেত্রেই এটি নিরাময়যোগ্য। যদিও সঠিক রোগনির্ণয়ের অপ্রতুলতা ও ব্যবস্থাপনা ঘাটতি থাকার কারণে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসার জটিলতা বাড়ছে সেই সাথে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবাও অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।

শিশুদের ক্যানসারের ধরন প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ভিন্ন হয়ে থাকে।


বিজ্ঞাপন


লিউকেমিয়া: এটি শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটি রক্ত ও অস্থিমজ্জার ক্যানসার। শিশুরা রক্তশূন্যতা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, জ্বর, হাড়ের ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তপাত এসব সমস্যা নিয়ে আসেন চিকিৎসকের কাছে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এটি ডায়াগনোসিস করা হয়।

লিউকেমিয়ার প্রধান ধরন: সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া। এই ধরনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

একিউট মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়া, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের মধ্যেই হতে পারে।

ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া, এটি প্রাপ্তবয়স্কদের বেশি হয়। ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।


বিজ্ঞাপন


ক্রনিক মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়া, মধ্যবয়সী ও বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম (Philadelphia Chromosome) নামক জিনগত পরিবর্তনের ফলে হয়ে থাকে।

লিউকেমিয়া শনাক্ত করতে বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা, রক্তকণিকার আকার ও গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। এছাড়াও বোন ম্যারো বা হাড়ের মজ্জা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে লিউকেমিয়া ক্যানসার সেল আছে কি না তা দেখা হয়। এছাড়াও বেশ কিছু  জেনেটিক ও সাইটোজেনেটিক পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে।

লিউকেমিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি: লিউকেমিয়ার প্রধান চিকিৎসা কেমোথেরাপি। এছাড়াও টার্গেটেড থেরাপি, ইমাটিনিব, ইমিউনোথেরাপি,রেডিওথেরাপি ছাড়াও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট  লিউকেমিয়া রোগীদের জন্য কার্যকর।

বাংলাদেশে লিউকেমিয়া: বাংলাদেশে শিশুদের ক্যানসারের মধ্যে লিউকেমিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে যথাযথ চিকিৎসা পেতে অনেক রোগীকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।

বাংলাদেশে লিউকেমিয়ার চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সন্ধানী হেমাটোলজি ইউনিট, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ স্পেশালাইজড সেন্টারগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে।

বাংলাদেশে লিউকেমিয়ার চিকিৎসাসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ: কেমোথেরাপি ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের ব্যয়বহুলতা। পর্যাপ্ত ব্লাড ক্যানসার বিশেষজ্ঞের অভাব। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও চিকিৎসা সীমিত পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়াও দেরিতে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

সামাজিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এক্ষেত্রে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত এবং তারা সহায়তা করলে চিকিৎসা ব্যয় ও জটিলতা অনেকাংশেই কমে যাবে। যদিও এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তবে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কেমোথেরাপি ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টসহ উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে সীমিত পরিসরে। তবে দ্রুত রোগ শনাক্ত করা গেলে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিলে অনেক শিশুই সুস্থ হতে পারে।

লিউকেমিয়া ছাড়াও শিশুদের বেশকিছু ক্যানসার দেখা যায়। যেমন: নিউরোব্লাস্টোমা, যা প্রধানত পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড বা নার্ভ টিস্যুতে হয়। এছাড়া উইলমস টিউমার, এটি কিডনির ক্যানসার। সাধারণত ৩-৪ বছরের শিশুদের মধ্যে হয়। শিশুরা পেট ফোলা, রক্তমিশ্রিত প্রস্রাব, জ্বর এসব সমস্যা নিয়ে আসেন। লিম্ফোমা; এটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের ক্যানসার, যা হজকিন (Hodgkin) ও নন-হজকিন (Non-Hodgkin) দুই ধরনের হতে পারে। রেটিনোব্লাস্টোমা; এটি মূলত চোখের রেটিনার ক্যানসার, যা সাধারণত দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে হয়। অস্টিওসারকোমা বা হাড়ের ক্যানসার, এটিও শিশুদের মাঝে দেখা যায়।

Child

শিশুদের ক্যানসারের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ: বেশির ভাগ শিশুদের ক্যানসারের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:

১. জেনেটিক বা বংশগত কারণ, রেটিনোব্লাস্টোমার মতো কিছু ক্যানসার পারিবারিকভাবে হতে পারে।

২. রেডিয়েশন ও পরিবেশগত বিষক্রিয়া: গর্ভাবস্থায় বা শিশু অবস্থায় তেজস্ক্রিয়তা ও রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ। ভাইরাল সংক্রমণ ও প্রতিরোধক্ষমতার দুর্বলতা বা কিছু শিশুর জন্মগত রোগের কারণে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকতে পারে।

শিশুদের ক্যানসার প্রতিরোধ: শিশুদের ক্যানসার প্রতিরোধ করা কঠিন, তবে কিছু সতর্কতা গ্রহণ করলে ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। যেমন:

গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা, ধূমপান, অ্যালকোহল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক থেকে দূরে থাকা। অর্গানিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। কিছু ভাইরাসজনিত ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি ও হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন কার্যকর। শিশুকে অপ্রয়োজনীয় রেডিয়েশন এক্সপোজার থেকে রক্ষা করা। বংশগত ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করা।

শিশুদের ক্যানসার একটি কঠিন বাস্তবতা, তবে আধুনিক চিকিৎসার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এটি নিরাময়যোগ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিশুর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক; ফেলো, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী; ফাউন্ডিং মেম্বার, ক্যানসার কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ট্রাস্ট

এমএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর