শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

ক্যানসারের যত ধরন, নামকরণ করা হয় যেভাবে

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

ক্যানসারের যত ধরন, নামকরণ করা হয় যেভাবে

রঙিন জীবনকে মুহূর্তেই নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে দেয় এমন একটি শব্দ ‘ক্যানসার’। হতাশা, ভয় আর আতঙ্ক যার প্রতিশব্দের মতো। একজন ব্যক্তির ক্যানসার ধরা পড়লে শরীরের পাশাপাশি আক্রান্ত হয় মনও। ভেঙে পড়েন তিনি। বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয় তার। রোগটি সম্পর্কে মানুষ এখনও সচেতন না হওয়ায় শেষ পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। আর সেখান থেকে ফিরে আসাও দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। 

ক্যানসার রোগটি কর্কট রোগ নামেও পরিচিত। এটি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। ইংরেজিতে একে Cancer বলা হয়। ক্যানসারের প্রকারের যেমন শেষ নেই, তেমনি এর নামেরও অন্ত নেই। স্থান ও কারণ ভেদে বিভিন্ন ক্যানসারের নাম নির্ধারণ করা হয়। এখনও পর্যন্ত ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যানসারের খোঁজ মিলেছে। প্রতিটি ক্যানসারই আলাদা এবং নামও ভিন্ন। এই প্রতিবেদনে জানুন কীভাবে ক্যানসারের নামকরণ করা হয়- 


বিজ্ঞাপন


ক্যানসার কী, এটি কেন হয়? 

এই প্রশ্ন প্রায় সবার মাথাতেই ঘুরপাক খায়। উত্তর জানতে আপনাকে ফিরে যেতে হবে স্কুলজীবনের জীববিজ্ঞান বইতে। মানুষের দেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে সৃষ্টি হয়। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। সেই স্থানে নতুন কোষ জন্ম নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। এটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। 

cancer2

কিন্তু এই কোষগুলো যখন কোনো কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। এই পরিস্থিতিকে টিউমার বলে। এই টিউমার ‘বিনাইন’ বা ‘ম্যালিগন্যান্ট’ হতে পারে। নিওপ্লাস্টিক কোষ আশেপাশের কলাকে ভেদ করতে না পারলে তাকে নিরীহ বা বিনাইন টিউমার বলে। এই টিউমার ক্যানসার নয়। মূলত ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যানসার বলা হয়। 


বিজ্ঞাপন


ক্যানসারের যত নাম 

বেশিরভাগ সময়েই শরীরের যে অংশকে আক্রমণ করেছে বা যে অংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে তার নাম অনুযায়ী ক্যানসারের নামকরণ করা হয়। তবে শরীরে অনেক অংশ যেহেতু বিভিন্ন ধরনের কলা বা টিস্যুর সমন্বয়ে গঠিত তাই অধিকতর সূক্ষ্মভাবে ক্যানসারের শ্রেণিবিন্যাস করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ক্যানসার সৃষ্টিকারী টিউমারের কোষ শরীরে যে ধরনের কোষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে তার ধরনের আশ্রয় নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী রোগটির শ্রেণিবিন্যাস ও নামকরণ করেছেন। এমন কিছু নাম সম্পর্কে জানুন- 

কার্সিনোমা

এপিথেলিয়াল বা আবরণী কোষ থেকে উদ্ভূত ক্যানসারকে কার্সিনোমা বলা হয়। প্রচলিত ক্যানসারগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ এই শ্রেণির ক্যানসারের অন্তর্গত। বিশেষত প্রাপ্তবয়স্করা যে ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তার বেশিরভাগই এর অন্তর্ভুক্ত। মানব দেহের স্তন, প্রোস্টেট, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, এবং মলাশয়ে যেসব ক্যানসারের বিকাশ ঘটে তার প্রায় সবই কার্সিনোমা হিসেবে পরিচিত।

cancer3

সার্কোমা

যোজক কলা (যেমন হাড়, তরুণাস্থি, চর্বি, স্নায়ু) থেকে উদ্ভূত ক্যানসারকে এই নামে চিহ্নিত করা হয়। এসব ক্যানসারের কোষগুলো অস্থি মজ্জার বাইরে থাকা মেসেনকাইমাল কোষ থেকে উদ্ভূত হয়ে ক্যানসার হিসেবে বিকশিত হয়।

লিম্ফোমা এবং লিউকেমিয়া

এই দুটি শ্রেণির ক্যানসারের সৃষ্টি হয় রক্ত তৈরিকারী কোষ থেকে। শিশুরা আক্রান্ত হয় এমন ক্যানসারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসার হচ্ছে লিউকেমিয়া, যার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। তবে অনেকসময় প্রাপ্তবয়স্কদেরও লিম্ফোমা ও লিউকেমিয়া ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

সেমিনোমা ও ডিসজার্মিনোমা

প্লুরিপোটেন্ট কোষ থেকে সৃষ্ট ক্যানসার, যা প্রায় সময়ই শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ে দেখা যায়; চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এদেরকে যথাক্রমে সেমিনোমা ও ডিসজার্মিনোমা নামে অভিহিত করা হয়।

cancer4

ব্লাস্টোমা

অপরিণত ‘পূর্ববর্তী’ (প্রিকার্সর) কোষ বা ভ্রূণীয় কলা (এম্ব্রায়োনিক টিস্যু) থেকে সৃষ্ট ক্যানসারকে ব্লাস্টোমা বলা হয়। এধরনের ক্যানসার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের বেশি হয়ে থাকে। 

ক্যানসারের নাম কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? 

সাধারণত নামের শেষভাগে -কার্সিনোমা, সার্কোমা, বা ব্লাস্টোমা প্রত্যয়যোগে ক্যানসারের নামকরণ করা হয়। আর নামের প্রথমাংশে থাকে ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ বা কলার নামের লাতিন (ল্যাটিন) বা গ্রিক শব্দ। 

এই যেমন- যকৃতের প্যারেনকাইমায় ম্যালিগন্যান্ট এপিথেলিয়াল কোষ থেকে সৃষ্ট ক্যানসারের নাম হেপাটোকার্সিনোমা, অন্যদিকে যকৃতের আদিম প্রিকার্সর কোষ থেকে সৃষ্ট ম্যালিগন্যান্সিকে বলা হয় হেপাটোব্লাস্টোমা, আর চর্বি থেকে সৃষ্ট ক্যানসারকে বলা হয় লিপোসার্কোমা। 

cancer6

অতি প্রচলিত কিছু ক্যানসারের ক্ষেত্রে অঙ্গের নামই ব্যবহৃত হয়। যেমন- সবচেয়ে প্রচলিত ধরনের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাবিজ্ঞানীয় নাম হচ্ছে স্তনের নালীয় কার্সিনোমা বা ম্যামারি ডাক্টাল কার্সিনোমা। এক্ষেত্রে ‘নালীয়’ বিশেষণটির দ্বারা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা ক্যানসারের উপস্থিতি বা চেহারাকে নির্দেশ করছে, যার মাধ্যমে বোঝাচ্ছে ক্যানসারটি দুগ্ধনালী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত শব্দের ওপর নির্ভর করে একে স্তন ক্যানসারই বলা হয়।

বেনাইন টিউমারগুলোর (যা ক্যানসার নয়) নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত নামের শেষাংশে ‘ওমা’ প্রত্যয়যোগে করা হয়। আর নামের প্রথামাংশে থাকে অঙ্গের নাম। উদাহরণস্বরূপ- মসৃণ পেশী কোষের বেনাইন টিউমারকে বলা হয় লেইয়োমাইওমা (যদিও জরায়ুতে প্রায়শই সৃষ্ট বেনাইন টিউমারের সাধারণ নাম হচ্ছে ফাইব্রোয়েড বা ইউটেরাইন ফাইব্রোয়েড)। 

তবে কিছু ক্যানসারের ক্ষেত্রে ‘নোমা’ প্রত্যয়যোগে করা হয় যা ‘ওমা’ প্রত্যয় যোগে করা বেনাইন টিউমারের সাথে প্রত্যয়গত কারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। যেমন মেলানোমা এবং সেমিনোমা দুটোতেই নোমা প্রত্যয় রয়েছে কিন্তু এগুলো বেনাইন টিউমার নয়।

cancer5

জেনে রাখা ভালো, কিছু ক্যানসারের নাম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে দৃশ্যমান টিউমার কোষের আকার ও আকৃতি অনুসারেও করা হয়। যেমন জায়ান্ট সেল কার্সিনোমা (বৃহৎ আকৃতির কোষ হওয়ায়), স্পিন্ডল সেল কার্সিনোমা (টাকু বা ঘুর্ণায়মান দণ্ডাকৃতির কোষ হওয়ায়) এবং স্মল সেল কার্সিনোমা (ছোট আকৃতির কোষ হওয়ায়)।

বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত ক্যানসারের ধরন 

আমাদের দেশে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসার বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- 

ফুসফুস ক্যানসার: এই ক্যানসারের প্রধান কারণ ধূমপান। বাংলাদেশে ধূমপানের প্রবণতা বেশি হওয়ার ফুসফুস ক্যানসারের হারও বেশি। 

স্তন ক্যানসার: নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসার এটি। নিজেদের শরীর নিয়ে এ দেশের বেশিরভাগ নারী অবহেলা করেন। আর তাই বাড়ছে স্তন ক্যানসারের হার। এই ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়লে এর হার কমানো সম্ভব।

colon

কোলন ক্যানসার: এটিও বেশ প্রচলিত একটি ক্যানসার। বৃহদন্ত্রের এই ক্যানসার অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হতে পারে। পাইলস ভেবে অনেকে অবহেলা করায় এই ক্যানসারের হার বেশি। 

লিভার ক্যানসার: ভাইরাল হেপাটাইটিস বি ও সি, অ্যালকোহল সেবন এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে লিভার ক্যানসার হয়। এটি যকৃতকে আক্রমণ করে। 

মুখ ও গলার ক্যানসার: ধূমপান এবং পান খাওয়া মুখ ও গলার ক্যানসারের প্রধান কারণ।

রক্তের ক্যানসার: আমাদের দেশে রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী সংখ্যাও অনেক। লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং মাইয়েলোমা এই ধরনের ক্যানসারের অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়াও মূত্রাশয় ক্যানসার, সার্ভিকাল বা জরায়ু মুখের ক্যানসার, কিডনি ক্যানসার, মূত্রথলির ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসারও অনেকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। রোগটি নিয়ে যত বেশি সচেতনতা বাড়ানো যাবে ততই এর হার কমানো সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর