শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‌‘রাগ করে বলেছিলাম— আন্দোলনে গেলে ঘরে আর জায়গা দেব না’

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

‌‘রাগ করে বলেছিলাম— আন্দোলনে গেলে ঘরে আর জায়গা দেব না’
শহীদ মুনতাসীর রহমান আলিফ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য দিন আজ। হাজারো ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার শাসনকালের অবসান ঘটার দিন। ছাত্র-জনতা এই দিনের নাম দিয়েছে ৩৬ জুলাই।

সেদিন স্বৈরাচরের পতনে রাজধানী ঢাকার রাজপথে বিজয় মিছিল করে উৎসুক ছাত্র-জনতা। কিন্তু যারা জীবন দিলেন তারা বিজয়ের সুখ নিতে পারলেন না। তাদেরই একজন মুনতাসির রহমান আলিফ।


বিজ্ঞাপন


শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আলিফ। একটি গুলি তার মাথা ভেদ করে তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়।

শহীদ মুনতাসির রহমান আলিফ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে একই মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়। এরই মধ্যে আন্দোলন শুরু হওয়ায় ক্লাস করার সুযোগ হয়নি তার।

এদিকে একমাত্র সন্তান আলিফকে হারিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক উপপরিচালক সৈয়দ গাজীউর রহমান (৭০) ও শিরিন সুলতানা (৫৫) দম্পতি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। প্রতিটি মুহূর্তে স্মৃতিকাতর হয়ে সন্তানের কথা ভাবেন।

শহীদ মুনতাসির রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ গাজীউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার সন্তান অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও সরল প্রকৃতির। তাকে আমরা কোথাও একা যেতে দেইনি। খুব আদরে বড় করেছি। তার কষ্ট হবে এমন কোনো কাজ কখনও দেইনি। আল্লাহ তাকে এই অল্প বয়সে নিয়ে গিয়ে আমাদের এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, আলিফ চুপি চুপি আন্দোলনে যেত। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমরা তাকে যেতে দিতাম না। ফলে সে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলতো। সেদিন ৫ আগস্ট তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করি। তবুও সে নাছোড়বান্দা যাবেই যাবে। পরে রাগ করে বলেছিলাম, ‘আজ বাসার বাইরে গেলে, ঘরে আর জায়গা দেব না’। ছেলেও রাগ করে বলেছিল— ‘ঠিক আছে বাসায় আর ফিরব না’। এটাই ছিল ছেলের সঙ্গে আমার শেষ কথা।

গাজীউর রহমান বলেন, এখন আফসোস হয়, কেন এভাবে বলেছিলাম- ছেলে জীবিত অবস্থায় আর বাসায় আসেনি; এসেছে লাশ হয়ে।

কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন এই বাবা। তিনি বলেন, রংপুরে আবু সাঈদসহ কয়েকজন শহীদ হওয়ার পরে তাকে আর থামানো যায়নি। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমরা তখন খুবই শঙ্কিত ছিলাম। আন্দোলনে যেতে বারণ করলে প্রতিউত্তরে আলিফ বলেছে, ভাইদের প্রাণ যাচ্ছে, আমি কিভাবে ঘরে বসে থাকি?

সেদিন ৫ আগস্ট দুপুরে খবর এলো স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। ঢাকার রাজপথে সর্বস্তরের জনতা তখন বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। কিন্তু আলিফের কোনো খবর পাচ্ছিল না তার পরিবার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও ঘরে ফিরেনি আলিফ। এতে উদ্বেগ বাড়তে থাকে আলিফের পরিবারের।

আলিফের বাবা জানান, সন্ধ্যায় বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং হচ্ছিল— বিভিন্ন জায়গায় লাশ পড়ে আছে। আমি কয়েক জায়গায় গিয়ে আলিফকে পাইনি। পরে স্থানীয় হাসপাতালেও গিয়ে না পেয়ে সরাসরি চলে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমরা যখন ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাই তখন রাত আনুমানিক ১২টা। প্রথমে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে খুঁজতে গেলাম। সেখানেও পেলাম না। এক পর্যায়ে এক নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে মর্গে আলিফকে খুঁজতে যাই। সাহসে কুলাচ্ছিল না কি করি। শত শত লাশের স্তূপ দেখে বুক কাঁপছিল। 

শেষে মর্গে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় ভোর ৪টায় ছেলের লাশ খুঁজে পান তিনি। অগণিত মৃতদেহের স্তূপের নিচে পড়ে ছিল আমার মুনতাসির বলে কেঁদে ওঠেন গাজীউর। ৬ আগস্ট কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

গাজীউর রহমান বলেন, আমার ছেলের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিভাও ছিল। লেখালেখি, গান, চিত্রাংকনে তার দখল ছিল। তার স্বপ্ন ছিল আলিম (এইচএসসি) শেষে বুয়েটে ভর্তি হওয়া। কিন্তু স্বৈরশাসক হাসিনা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

আলিফের সাথীরা জানায়, আলিফ সবসময় আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকতো। জাতীয় পতাকার ছবি আঁকা টি-শার্ট গায়ে দিত, মাথায় পতাকা বাঁধত। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মুনতাসির কখনও পিছপা হয়নি। পুলিশের দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করেও সে অনড় ছিল।

আলিফের সতীর্থ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, আলিফ নম্র ও ভদ্র ছিল। সব সময় হাসিমুখে কথা বলতো। তাকে হারানোর শূন্যতা কখনও মিটবে না। আল্লাহ তাকে কবুল করে নিয়েছেন। দোয়া করি তাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন। তার বাবা ও মাকে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দেন।

এমআর/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর