শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঢামেকের সেই বীভৎস চিত্র দেখে কেঁদেছেন অনেকেই

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

DMC
ঢামেকের চিত্র ছিল ভয়াবহ। ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা আন্দোলনের শুরুটা শান্তিপূর্ণ হলেও ১৫ জুলাই থেকে তা সহিংস রূপ নেয়। ১৬ জুলাই থেকে একের পর লাশ পড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আহতদের সংখ্যা। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শুধু রাজধানী নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকেও গুরুতর রোগীদের নিয়ে আসা হয় ঢামেকে। জুলাই আন্দোলনেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এমনিতেই যেখানে সরকারি এই হাসপাতালটিতে রোগীতে ঠাসা থাকে, তখন কয়েক গুণ বেড়ে যায় রোগীর সংখ্যা।

রাজধানীর আন্দোলনে আহতদের বেশির ভাগের চিকিৎসার ঠিকানা ছিল ঢামেক। তখন সেখানকার পরিস্থিতি ছিল খুবই ভয়াবহ। বীভৎস সেই চিত্র দেশে অনেককে কান্না করতে দেখা গেছে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে রোগীদের। এমনকি হাসপাতালে ঢুকে হামলা চালানোর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আন্দোলনে আহতদের আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিয়েছেন এখানকার চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।


বিজ্ঞাপন


গত বছরের আগস্টের শুরুর দিকে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় ঢাকা মেডিকেল এলাকায় আন্দোলনের সংবাদ কাভার করেন পত্রিকাটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক রাহাদ উদ্দিন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, সে সময়ের দৃশ্য খুবই ভয়াবহ এবং বীভৎস ছিল। আন্দোলনে আহতদের রক্তের দাগ লেগেছিল পুরো ঢাকা মেডিকেলজুড়ে। রক্তের কারণে হাঁটার মতো পরিস্থিতি ছিল না। হাসপাতালের সবখানে রক্ত লেগেছিল। খুবই ভয়াবহ দৃশ্য। কেউ এমন দৃশ্য দেখার পর স্থির থাকতে পারবে না। যেসব রোগী আসত, তাদের অবস্থাও ছিল খুবই করুণ। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকার যেসব রোগী আসত, তাদের বেশির ভাগ ছিল গুলিবিদ্ধ। তাদের শরীর থেকে তাঁজা রক্ত পড়ত। খুবই করুণ সেই দৃশ্য।

রোগীর চাপ, লাশের মিছিল

রাহাদ উদ্দিন বলেন, এত বেশি রোগীর চাপ ছিল যে, হাসপাতালের কোথাও কোনো জায়গা ফাঁকা ছিল না। এমনিতেই ঢাকা মেডিকেল রোগীতে ঠাসা থাকে। সে সময় প্রতি মুহূর্তে রোগী আসতে থাকে এখানে। কাউকে রিকশায় করে, কাউকে ভ্যানে আবার কাউকে অ্যাম্বুলেন্সে আনা হচ্ছিল। জায়গা সংকটের কারণে হাসপাতালের বাইরে গাড়ি পার্কিংয়ের যে জায়গা সেখানেও বেড বিছিয়ে রোগীদের সেবা দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এই সাংবাদিক বলেন, অনেক সময় এমন দৃশ্যও দেখা গেছে, আহতদের সঙ্গে কেউ ছিল না। পরে স্বজনরা এসে খুঁজে বের করে নিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা সেসময়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি।


বিজ্ঞাপন


এই সাংবাদিক বলেন, ছোটবেলায় পড়েছিলাম বাতাসে লাশের গন্ধ, কিন্তু জুলাই-আগস্টে নিজ চোখে লাশের সারি দেখেছি। এত বীভৎস চিত্র ছিল সে সময়টাতে, বলে বোঝানো যাবে না। ঢাকা মেডিকেলজুড়ে লাশ আর রক্তের গন্ধ। কিছুক্ষণ পরপর লাশের গাড়ি আসত এবং স্বজনরা নিয়ে যেত। অনেক লাশের ময়নাতদন্তও হয়নি। ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্বজনরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে গেছে।

DMC2
ঢামেকের মর্গে ছিল লাশের মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

দৈনিক সমকালের নিজস্ব প্রতিবেদক তবিবুর রহমান সেই সময় ঢাকা মেডিকেলে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ৫ আগস্ট যখন সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাসা থেকে বের হলাম, তখন বাজে বেলা ১১টা। পলাশীর মোড় হয়ে রিকশা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার চেষ্টা করি। পুলিশ আমাদের আটকে দেয় এবং বলে- আপনারা যেতে পারবেন না। এরপর আমরা বললাম, আমরা তো সাংবাদিক, আমাদের কার্ড আছে এবং আমরা যেতে চাই। তখন চাঁনখারপুলে চারিদিকে পুলিশের গুলি। এরপর গুলি উপেক্ষা করে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেইট দিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে যাই। সেখানেও পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আমাদের সামনেই দুজন গুলিবিদ্ধ হন। ওই এলাকাতে তখনই পাঁচ থেকে সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং স্পটেও মারাও গেছেন। তখন হাসপাতালের ভেতরে অন্তত হাজারখানেক শিক্ষার্থী ছিলেন।

এই সাংবাদিক বলেন, ওই সময়টা খুবই উদ্বেগের ছিল। গুলিবিদ্ধদের রক্তে হাসপাতালের মেঝে পুরোটা ভিজে যায়। হাসপাতালে আহতদের আসা অব্যাহত ছিল। মিনিটে ২-৩টা অ্যাম্বুলেন্স আসছিল। এই অবস্থায় তখন দুপুর একটা বাজে, টেলিভিশনের পর্দায় দেখাচ্ছে সেনাপ্রধান সংবাদ সম্মেলন করবেন। তখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু একের পর এক লাশ আসতে থাকে। বাড়তে থাকে আহতদের ভিড়।

ঢামেকের জরুরি বিভাগের তথ্যমতে, সহিংসতার ঘটনায় ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক আহত মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। ৭০ জন ভর্তি হন। ৩৬ জনের লাশ গ্রহণ করা হয়। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকের লাশ নিয়ে যান স্বজনরা।

চিকিৎসকের ভাষ্যে ভয়াবহ সেই চিত্র

সব বাধা ও ভয় উপেক্ষা করে আন্দোলনে আহত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেন ঢামেকের চিকিৎসকরা। তাদের একজন হাসপাতালটির আইসিইউ বিভাগের ডা. আল কায়েস সরকার। জুলাই-আগস্টের স্মৃতিচারণ করে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ১৮ জুলাইয়ের আগে থেকেই আমরা আহত রোগীদের সেবা দিয়েছি। ১৮ তারিখ থেকে পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তখন থেকে আমরা মানবিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিই। ইর্মাজেন্সি ওয়ার্ড থেকে শুরু সবখানে রোস্টারের মাধ্যমে সেবা প্রদান করি। বিশেষ করে ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ড, সার্জারি ওয়ার্ড ও নিউরোসার্জারি ওয়ার্ড- এই তিন ওয়ার্ডে রোস্টারের মাধ্যমে টানা কয়েক দিন সেবা দিয়েছি।

ঢামেকের এই চিকিৎসক বলেন, আমরা চিকিৎসকরা তিন ভাগে সেবা দিয়েছি। এক ভাগ ইর্মাজিন্স রোগীদের সামাল দিয়েছে। আরেক ভাগের কাজ ছিল- অস্ত্রোপচারের পররর্তী সময়ে ফলোআপ দেওয়া। সেই সময় চিকিৎসক সংকটও ছিল। সড়কে সমস্যার কারণে অনেকেই হাসপাতালে আসতে পারছিলেন না। এরপর আরেক ভাগের কাজ ছিল, ওটিতে কার কী প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী সেবা প্রদান করা।

ডা. আল কায়েস সরকার বলেন, ওই সময় বেশির ভাগ রোগীর সঙ্গে কোনো অ্যাটেনডেন্স (আত্মীয়-স্বজন) ছিল না। এমন এমন রোগী দেখেছি, যা আগে কখনো দেখিনি। আমরা তিনটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনি সম্ভবত বাজার করার জন্য বের হয়েছিলেন। তাকে গলায় গুলি করা হয়েছে। তার শ্বাসনালি দিয়ে গুলি ঢুকে পেছন থেকে বের হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে একজন রোগী আসছিলেন, তিনি মাদরাসার শিক্ষক। তিনি ক্লাস নেওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। তার গলায় গুলি লেগেছিল। গরু জবাই করলে যেমন রক্ত বের হয়, জাস্ট পিনকি দিয়ে সেভাবে রক্ত বের হচ্ছিল। আরেকজন ছিল কিশোর, তার দুই চোখে গুলি লেগেছিল। সে আর কখনো পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না।

DMC3
প্রতি মিনিটে আসছিল রোগী। ছবি: সংগৃহীত

এই চিকিৎসক বলেন, ৫ আগস্টের আগে যেসব রোগী আসত, তাদের অবস্থা খুবই ভয়াবহ ছিল। কারও মাথার খুলি উড়ে গেছে। এসব রোগীর বেশির ভাগ বাঁচেনি। আমি সেবা দিয়েছি, ইমার্জেন্সি সেবা। সবচেয়ে খারাপ রোগীগুলো এখানে আসত। মৃত রোগীগুলোকে একপাশ করে দেওয়া হতো, পরবর্তী সময়ে তাদের স্বজন নিয়ে যেত। আরেক পাশে যাদের লাইফ সাপোর্ট বা আইসিইউ প্রয়োজন, তাদের সেখানে পাঠানো হতো।

ডা. আল কায়েস সরকার বলেন, আন্দোলনে আহত রোগীদের আন্দোলনকারীরা ধরে নিয়ে আসত। তারা যেভাবে পেরেছে, আহতদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তাৎক্ষণিক রোগীদের সঙ্গে কোনো স্বজন ছিল না। হাসপাতাালে অনেক স্বেচ্ছাসেবী ছিল, তারা খুবই সহযোগিতা করত।

ঢামেকের এই চিকিৎসক বলেন, ৫ আগস্টের আগে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে আসত, তাদের পুলিশ পাহারা দিতো। কারণ সরকারের চোখে তারা ছিল দুষ্কৃতকারী। একবার শুনলাম, রোগী ভর্তি হওয়ার কিছুক্ষণ পর আত্মীয়-স্বজন যারা আসছিল, তাদের ধরে নিয়ে গেছে। আর যারা ভর্তি ছিল তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং এনআইডি কার্ড নিয়েছে পুলিশ। আহতরা সুস্থ হলে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা এক সময় রোগীর স্বজনদের বলতে বাধ্য হয়েছি, আপনারা যদি পারেন রোগীটা এখান থেকে সরান। না হয়, এ অবস্থায় পুলিশ রোগীকে আটক করার একটা আশঙ্কা আছে। রোগীর অবস্থাও খারাপ।

ডা. আল কায়েস সরকার বলেন, অধিকাংশ রোগীর ফুসফুসে আঘাত লাগে। তাদের সবসময় পুলিশ পাহারা দিতো। রোগীদের বেশির ভাগ ছিল পথচারী বা শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের তো সাপোর্ট ছিল। ভ্যানচালক-রিকশাচালক তাদের নিদারুণ কষ্ট হয়েছে। তাদের তেমন কোনো সাপোর্ট ছিল না বা সহযোগিতার মতো কেউ ছিল না।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর