বিশেষ কারও আহ্বানে নয়, সিফায়েত চৌধুরী গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিজের বিবেকের তাড়নায়। উত্তাল সেই রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন বুক চিতিয়ে, অধিকার আদায়ের জন্য, জালিম শাসকের বিরুদ্ধে। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ফ্যাসিবাদ পতনের এক বছর পার হলেও সিফায়েত চৌধুরী এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বরং, সঠিক চিকিৎসার অভাবে তিনি ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। জুলাই যুদ্ধাহত এই ছাত্রনেতা আজ সমাজের এক উপেক্ষিত নাম।
বিজ্ঞাপন
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাপুলিয়া গ্রামে সিফায়েত চৌধুরীর বাড়ি। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনিই সবার ছোট। আন্দোলনের সময় তিনি গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের মাস্টার্স শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পিতা আছাদ চৌধুরী কৃষিকাজ করতেন, এখন বয়সের ভারে অক্ষম। বড় ভাই বহু আগেই মারা গেছেন, মেঝো ও সেজ ভাই মসজিদে ইমামতি করতেন, যার মধ্যে একজন বর্তমানে বেকার।
আরও পড়ুন—
মেধাবী ছাত্র সিফায়েত এখন দিনরাত ভাবলেশহীনভাবে পড়ে থাকেন বিছানার এক কোণে। প্রায়ই মাথার ভেতরে ঝিঁঝিঁ শব্দ হয়, কথা বলেন এলোমেলোভাবে। পরিবারের লোকজনকেও চিনতে পারেন না ঠিকমতো। তার এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ মা-বাবা। পরিবার আশঙ্কা করছে, দ্রুত উন্নত চিকিৎসা না পেলে সিফায়েতের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে জানা যায়, তিনি খুব বেশি কথা বলেন না, অতীতের অনেক কিছুই মনে নেই। তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘লং মার্চ ফর ঢাকা’-তে অংশ নিতে নবীনগর এলাকায় গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। হঠাৎ পুলিশের গুলিতে ছয়টি ছররা লাগে শরীরের বিভিন্ন অংশে। এরপরও থেমে যাননি তিনি।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট তার কানের পেছন দিয়ে ঢুকে সামনের দিকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। বন্ধুরা মিলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর কী হয়েছিল, তা আর মনে নেই তার।
সরকারের কাছে তার একমাত্র অনুরোধ বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা ও যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি।
সিফায়েতের সেজ ভাই সাফায়েত বলেন, ‘৫ আগস্টের পর প্রথম দিকে অনেক লোক বাড়িতে আসত, খোঁজখবর নিত। এখন আর কেউ আসে না। সরকারি অফিসে গেলে আমাদের মানুষই মনে করে না, খারাপ ব্যবহার করে। আগে ইমামতি করতাম, ভাইয়ের চিকিৎসা ও দেখভাল করতে গিয়ে সেই চাকরিটাও হারিয়েছি। আমার নিজের সংসারই চলছে না।’
তিনি জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা করে সহযোগিতা পেয়েছিলেন, কিন্তু তা পুরোটাই চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে গেছে। এখন উন্নত চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ নেই।
সিফায়েতের মা মিনি বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘আহত ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আর কয়দিনই বা বাঁচবো? আমার ছেলের কী হবে? কে দেখবে ওকে?’
বাবা আছাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কোনোভাবে সংসার চলে। ঢাকায় অপারেশনের পর কিছু ওষুধ এনেছিলাম, তা-ও শেষ হয়ে গেছে। ওর শারীরিক অবস্থাও ভালো না, প্রায়ই ভুলভাল কথা বলে। উন্নত চিকিৎসার খুব দরকার। যেখানে দু’বেলা ভাত জোটে না, সেখানে ওর চিকিৎসা চালাব কীভাবে?’
নিজেই বলেন সিফায়েত চৌধুরী কোনো কিছুর আশায় আন্দোলনে যাইনি, বিবেকের তাড়নায় গিয়েছিলাম। আজ আহত হয়ে ঘরে পড়ে আছি, পরিবারের বোঝা হয়ে গেছি। চোখের সামনে শুধু অন্ধকার। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি। তাহলেই হয়তো আবার বাঁচতে পারতাম।
প্রতিনিধি/একেবি

















































































