- পুত্রশোকে কাতর হয়ে চাকরি হারান নাঈমের বাবা
- অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই কি অপরাধ- প্রশ্ন নাঈমের বাবার
- খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি পরিবারের
কলেজ শিক্ষার্থী নাঈমের স্বপ্ন ছিল বিচারক হয়ে দেশে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। গড়ে তুলবেন বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। নাঈমের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। অকালে ঝরে যায় নাঈমের স্বপ্ন ও জীবন। বাবা মায়ের দেওয়া নাম নাঈম থেকে হলেন শহীদ নাঈম।
বিজ্ঞাপন
২০২৪ এর ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন একের পর এক নিহতের সংবাদ আসতে থাকে। এতে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা ঘরে বসে থাকতে পারেনি। ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে চাঙ্গা হতে থাকে যাত্রাবাড়ীর আন্দোলন। যাত্রাবাড়ীকে বলা হয় জুলাই আন্দোলনের স্ট্যালিনগ্রাদ। এখানে পুলিশের নির্বিচার গুলি কয়েকশ ছাত্র-জনতার জীবন কেড়ে নেয়। তার মধ্যে শহীদ নাঈম অন্যতম। পুলিশের ছোড়া বুলেট বিদ্ধ করে নাঈমের বুক।
শহীদ নাঈমের বাবা কামরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে জানান, ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী স্কুলের পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আমার সন্তান নাঈম। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে জজ (বিচারপতি) হবে, সমাজের অনিয়ম দূর করবে—কিন্তু হঠাৎই থেমে যায় সেই স্বপ্নযাত্রা।
নাঈমের বাবা আজও সেই মুহূর্ত ভুলতে পারেন না। আবেগে কণ্ঠ ভারী করে তিনি বলেন, ওরা আমার আদরের সন্তানকে কলেজের গণ্ডিও পার হতে দেয়নি। কত আশা ছিল ওকে নিয়ে। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে—কখনও ভাবিনি।
তিনি আরও জানান, এখন প্রতিটি দিন কাটে শুধু নাঈমের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ছবি যেন কথা বলে তার অনুপস্থিতির। নানা স্মৃতি বহন করে দিন কাটাচ্ছি। ‘মনে হয়, দরজায় আবার ডাক দেবে আমার ছেলে’— চোখের পানি মুছে বলেন নাঈমের বাবা।
বিজ্ঞাপন
১৭ বছরের নাঈমের নিহত হওয়ার এক বছর পার হলেও অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি বিচার চাই। আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বৈষম্যহীন ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিল।
নাঈম এখন শুধুই এক নাম নয়— সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক সাহসী তরুণের প্রতিচ্ছবি। তার মৃত্যু দেশের তরুণ সমাজকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়— আদৌ কি আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে বাস করছি?
নাঈমের বাবা কামরুল ইসলাম এখনও ছেলের মুখখানা ভুলতে পারেন না। নানা স্মৃতি বহন করে দিনাতিপাত করছি। প্রতিদিন সকালে মনে হয়, দরজায় এসে আবার বলবে— ‘বাবা, কলেজ যাচ্ছি’। কিন্তু সে আর ফিরবে না। শুধু অপেক্ষাই রয়ে গেছে।
শহীদ মো. নাঈম নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সানারপাড় রওশারা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছিলেন। পড়ালেখায় মনোযোগী ও মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সহপাঠীরাও নাঈমের এমন মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।
এদিকে সন্তানকে হারিয়ে নাঈমের বাবা গার্মেন্টস কর্মী কামরুল ইসলাম শোকে পাথর হয়েছেন। আদরের সন্তান হারানোর শোকে আর স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। মানসিকভাবে তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। ফলে তার আর কাজে যোগ দেওয়া হলো না।
কান্না জড়িত কণ্ঠে নাঈমের বাবা বলেন, আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানাতে গিয়েছিল। আমি শুধু চাই— আমার ছেলের মৃত্যুর বিচার হোক। আর যেন কোনো বাবাকে তার সন্তানের লাশ কাঁধে না তুলতে হয়।
স্মৃতিচারণ করে নাঈমের বাবা বলেন, নাঈমের কথা মনে পড়লেই নাঈমের শরীরের গন্ধ পাই। তার জামা-কাপড়গুলো পড়ে আছে। গত ঈদে শখ করে কেনা পাঞ্জাবিটি ঈদের দিনের পর আর পড়া হয়নি। সব সময় নাইম আমাকে বলতো, বাবা আমার জন্য দোয়া করবে আমি বড় হয়ে তোমাদের সুখে রাখব।
কামরুল ইসলাম ও মাহমুদা পারভীনের দুই ছেলের মধ্যে নাঈম ছোট। বড় ছেলে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী।
নাঈমের বাবা-মা সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, সেদিন ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজ আদায় করে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আন্দোলনে যোগ দেয় নাঈম।
মাহমুদা পারভীন জানান, বিরতিহীনভাবে পুলিশের গুলির আওয়াজে আমার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়। আমি আমার নাঈমকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। পরে ওর বাবাকে খুঁজে দিতে বললে তিনি বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসেন।
সন্ধ্যার পরেও নাঈম বাসায় না ফিরলে বাবা-মা দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারফিউর মধ্যেই খোঁজখবর নেন। কোথাও কোনো হাদিস মিলছে না। পরে বড় ছেলেকে নিয়ে কামরুল ইসলাম রাত আড়াইটা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী ও ডেমরার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ছেলের সন্ধান করেন। কিন্তু কোথাও পাননি। অবশেষে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান তিনি।
কামরুল ইসলাম জানান, দুই হাজারের অধিক ভর্তি থাকা আহত রোগীদের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে এবার মর্গে খোঁজা শুরু করলাম। শতাধিক লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম এখানেও নাঈম নেই। তখনও বুঝতে পারিনি নাঈম আর বেঁচে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফ্রিজিং মর্গে ছেলের নিথর দেহ খুঁজে পান। সন্তানের রক্তাক্ত লাশ দেখে তার মা অজ্ঞান হয়ে যায়।
মাহমুদা জানান, বাড়ির প্রতিটি কোণে ওর স্মৃতি। দরজায় কেউ নক করলেই মনে হয়, নাঈম এসেছে। এখনও প্রতিদিন দুপুর ৩টায় ওর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকি। আমরা নাঈম হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
নাঈমের সহপাঠী সাইফুল ঢাকা মেইলকে জানায়, নাঈম আমাদের খুব ভালো বন্ধু ছিল। সেদিন ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। একপর্যায়ে গুলিতে সে নিহত হয়।
এমআর/এফএ

















































































