মহামারী করোনার প্রাদুর্ভার শুরুর পর অনেকটা ওলটপালট হয়ে যায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। যার ভুক্তভোগী হন শিক্ষার্থীরা। পাবলিক পরীক্ষায় কখনো অটোপাস, কখনো আবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসসহ নানা বিষয়ে ছাড় দিতে হয় তাদের। আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে কয়েক বছর পর এবার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সার্বিক ফলাফলে গতবছরের তুলনায় অগ্রগতি হলেও এবার কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
অন্যদিকে ৫১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ যেমন পাস করেননি তেমনি একাধিক শিক্ষাবোর্ডে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ খারাপ করেছে গণিত, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের একাধিক বিষয়ে। অন্যান্য বছরও এসব বিষয়ে খারাপ করায় সার্বিক ফলাফলের পাসের হার কম হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এই বিষয়গুলোর দক্ষ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক সংকটের কারণে বারবার একই পরিস্থিতি হচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
বিজ্ঞাপন
রোববার প্রকাশিত সার্বিক ফলাফল নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সন্তোষ প্রকাশ করলেও জিপিএ-৫ কমার কারণ খোঁজার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ফলাফলে পিছিয়ে থাকা বোর্ডগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারাও বলছেন, কেন সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ফলাফল খারাপ করছে, জিপিএ-৫ কমছে তা তারা খতিয়ে দেখবেন।
আরও পড়ুন
তবে এ বছর গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন অনেক বেশি কঠিন হওয়ায় এই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে জানিয়েছেন ফলাফলে পিছিয়ে থাকা বোর্ড চেয়ারম্যান।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. নিজামুল করিম গণমাধ্যমকে গণিতে প্রশ্ন কঠিন হওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গণিতে প্রশ্ন তুলনামূলক কঠিন হওয়ায় স্মরণকালের মধ্যে খারাপ ফল করেছে কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এজন্য এ বোর্ডের মোট জিপিএ-৫ কমেছে। গণিতে এত খারাপ হওয়ার কারণ কী তা উদঘাটন করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
সদ্য প্রকাশিত ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডে গড় পাসের হার ৮৩.০৪ শতাংশ। ১ লাখ ৮২ হাজার ১৩২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২০২৩ সালে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। সবমিলিয়ে এবার পাসের হার বাড়লেও কমেছে জিপিএ-৫।
আরও পড়ুন
পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে যশোর বোর্ড, আর সর্বনিম্ন পাসের হার সিলেট বোর্ডে। এবার ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
সার্বিক ফলাফল নিয়ে আলোচনার মধ্যে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জিপিএ-৫ কমার বিষয়টি। শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রাথমিকভাবে পাঁচ শিক্ষা বোর্ডে গড়ে গণিতের ফল খারাপ হওয়া, সিলেট ও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সার্বিক ফল খারাপ হওয়া, করোনার প্রভাব এবং অনলাইন ক্লাসের প্রভাব দেখছে।
বিশেষ করে এ বছর যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন ২০২২ সালে। তার আগে প্রায় দুই বছর ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করেছে এসব শিক্ষার্থী।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বলেছেন, জিপিএ-৫ কমার সবচেয়ে বড় কারণ সব শিক্ষা বোর্ডে গণিতে খারাপ ফল আসা। পাঁচটি শিক্ষা বোর্ড গণিতে গড়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে। এজন্য জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। তাছাড়া কিছু বোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতেও ফল খারাপ হয়েছে। সার্বিক ফলের ওপর যার প্রভাব পড়েছে।
প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, বরিশালে ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, সিলেটে ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৮৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও যশোরে ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
এদিকে এ বছর মোট ২৯ হাজার ৮৬১টি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিলেও ৫১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো পরীক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। ২ হাজার ৯৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার শতভাগ।
ফলাফলে পিছিয়ে থাকা সিলেট বোর্ডের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বোর্ডে গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করার কারণে গড় পাসের হার কমেছে। এই বোর্ডে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করেছে বলেও ফলাফলে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন
অবশ্য সার্বিক ফলাফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের এসএসসির ফল ভালো হয়েছে। ফলের সার্বিক দিকে বিশ্লেষণ করলে ভালো দিক বেশি।
ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষামন্ত্রী বলেন, করোনার আগের বছর ২০১৯ বা তার আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ওই সময় পাসের হার সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের ঘরে থাকত। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়ে ৯০ শতাংশের বেশি হয়। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। গত বছরের মতো এবার পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। তাই এ বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষায় ফেরায় ফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। এটাকে স্বাভাবিক ফল বলা যায়। এবার জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে, তবে এটাকে খারাপ ফল বলা যাবে না।
বিইউ/এমআর